২।
সূর্য তখন মাথার উপরে উঠে গিয়েছ। রিয়া ধীরে ধীরে হাঁটছিল। বিশাল বাড়ি। একপাশে ধানমন্ডি লেক। অন্য পাশে উঁচু পাঁচিল। শহরের ব্যস্ত রাস্তা হুট করে এখানে শেষ হয়ে গিয়েছে। রাস্তার শেষ মাথায় বাড়িটি। দেখে মনে হয় আগের যুগের কোন বনেদি বাড়ি। রিয়া বিশাল লোহার গেটের সামনে দাঁড়াল। একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। ওর খুব গরম লাগছিল।পা ভারী, চলা ধীর, কিন্তু ও থামল না। রিয়ার আর ফিরে যাবার পথ নেই।
বাড়ির সামনে বিশাল দরজা। নিঃশব্দ প্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে আছে। বাড়িটা দোতালা। পালিশ করা পাথরের দেয়াল, চকচকে জানালা। দেখতে অনেকটা আয়নার মতো।রিয়া ইন্টারকমের বোতাম টিপল।
একটা নারী কণ্ঠ ভেসে এল। “কে?”
“আমি রিয়া, কাজের জন্য এসেছি।”
দরজাটি গর্জন করে খুলে গেল। রিয়া পরিষ্কার মেঝেতে পা রাখল। এখানকার বাতাসের গন্ধ আলাদা—পরিষ্কার, সুগন্ধ। একজন বয়স্ক মহিলা বেরিয়ে এলেন। তিনি রোগা, তীক্ষ্ণ চেহারা। তার পাকাচুল শক্ত করে বাধা। তিনি রিয়াকে উপরে নিচে দেখলেন। চোখ মুখে স্পষ্ট বিরক্তি।
“তুমি দেরি করেছ,” মহিলাটি চাপা গলায় বললেন।
“মাফ করবেন, ম্যাডাম,” রিয়া মৃদু স্বরে বলল।
“মাফ চাওয়ার কিছু নেই।এখানে কাজ করতে ফিরে এসেছ, সেটাই গুরুত্বপূর্ণ। আমার সাথে এস।”
রিয়া ভিতরে ঢুকল। ভিতরের অংশটি জাঁকজমকপূর্ণ—মার্বেলের মেঝে, ক্রিস্টাল ঝাড়বাতি, এবং দেয়ালজুড়ে দামী শিল্পকর্ম। এটা বাড়ির চেয়ে বেশি যাদুঘরের মতো মনে হয়।
ওরা একটি সিঁড়ি বেয়ে দ্বিতীয় তলায় উঠল। একটি বড় কাঠের দরজার সামনে থামল। মহিলা রিয়ার দিকে ফিরলেন। তার কঠোর চেহারা কিছুটা নরম হয়ে এল।
‘তুমি ফিরে এসেছ এতে আমি খুব অবাক হয়েছি। যারা এই বাড়ি থেকে একবার চলে যায় তারা আর কখনো ফিরে আসে না’
রিয়া কিছু বলল না।
-তোমাকে আমার পছন্দ হয়েছে। তোমাকে সব বুঝিয়ে দিয়ে আমি বিদায় নেব। যাওয়ার আগে অবশ্য এই বাসায় টিকে থাকার একটা বুদ্ধিও শিখিয়ে দেব। আশা করি এরপর আর তোমার এখানে থাকতে কষ্ট হবে না।
কথা শেষ করে মিসেস আখতারের রুমে ঢুকল।
ঘরটি অন্ধকার। ভারী পর্দা সূর্যের আলোকে আটকে রেখেছে। বাতাসে ওষুধ এবং কিছুটা ফুলের গন্ধ। বিছানায় মিসেস আখতার শুয়ে আছেন। একজন দুর্বল চেহারার মহিলা, সাদা চুল এবং গালের হাড় উঁচু। তার চোখ বয়সের ভারে গর্তে ঢুকে গেছে।
“এটা কে?” মিসেস আখতার জিজ্ঞাসা করলেন, তার গলা কর্কশ।
“নতুন মেয়েটি ,” মহিলাটি উত্তর দিলেন। “এখন থেকে আপনার যত্ন নেবে।”
মিসেস আখতারের দৃষ্টি রিয়ার উপর আটকে থাকল, ওকে এমনভাবে দেখল যে এখনই গিলে খাবে।
“মাগিটা না ভেগে গেছিল,” মিসেস আখতার খেঁকিয়ে উঠলেন।
-ছোট মানুষ, না বুঝেই চলে গিয়েছিল। এখন আবার এসেছে।
-এসে কি বাল ছিঁড়তেছে? আমার খাওন কই?
মহিলাটি রিয়াকে কাছে আসার ইশারা করলেন। “শুরু করো । রান্নাঘর নিচ তলায়। তাড়াতাড়ি খাবার নিয়ে এস ।”
রিয়া মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। ওর বুক কাঁপছে।মিসেস আখতারের চেহারা মরা লাশের মত। তার উপর গালাগালির স্বভাব। এই মহিলার সাথেই রিয়াকে এখন থেকে থাকতে হবে। সেটা কতদিন কে জানে।
খাবার নিয়ে রুমে ফিরল।রিয়ার নাকে বাজে একটা গন্ধ আসল। মিসেস আখতার অজ্ঞান হয়ে আছে। পাশে মহিলাটি দাড়িয়ে আছে। হাতে একটি ইনজেকশন।
-তোমাকে বলেছিলাম এখানে থাকার একটা বুদ্ধি শিখিয়ে যাব। শিখিয়ে যেতে হল না, তুমি নিজ চোখে দেখার সুযোগ পেলে।যখনই দেখবে সামলাতে পারছ না, ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পারিয়ে দেবে।
-কখন বুঝব সামলানো যাবে না?
-এই যে এখন। বেশি বাড়াবাড়ি করছিল।
-কি করছিল?
-বিছানায় পায়খানা করে সেগুলো ছুড়ে মারছিল।
রিয়া যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিল না। এরকম কেউ করতে পারে।
-এত ঘাবড়ে যাওয়ার কিছু নেই।এরাত আর এমনিতেই তোমাকে এতগুলো টাকা দেবে না। কষ্ট আছে। প্রথম কিছুদিন খারাপ লাগবে। এরপর দেখবে শিখে গেছ। আপাতত যেটুকু ওষুধ দিয়েছি তাতে কাল ভোর পর্যন্ত ঘুমাবে। তুমি নিজেকে এর মধ্যে গুছিয়ে নাও।
রিয়া কোন রকমে নিজের বমি সামলে নিচে নেমে এল।
বিকেলে আর কোন কাজ ছিল না। বিশাল বাড়ি ঘুরে ঘুরে দেখল। রান্না করা, ঘর পরিষ্কার, মিসেস আখতার এর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে মাঝে মাঝে কিছু লোক আসে, তাদের সাথে কিভাবে যোগাযোগ করতে হবে তা শিখিয়ে দিয়ে মহিলাটি চলে গেল। বাকিটা সময় একা।
রাতে বিছানায় শুয়ে ঘুম আসছিল না । কেমন গা ছম ছম করছিল। মনে হচ্ছিল এই বুঝি মিসেস আখতার ঘুম থেকে উঠে এসে ওর গলা চেপে ধরল। মনটা অন্য দিকে সরাতেই রিয়া ফোন হাতে নিল। রিয়ার নিজের একটা ফোন ছিল। অনেক কষ্টে টাকা জমিয়ে কিনেছিল। ওর হারামি বাপ সেই ফোন চুরি করে বিক্রি করে দিয়েছিল। জুয়া খেলার টাকা লাগত। এই বাসায় আসার পর রিয়া নতুন একটা ফোন পেল। সবার সাথে যোগাযোগ করার জন্য। সেই ফোনে বেশ কিছু নাম্বার সেভ করা আছে। এর মধ্যে একটা নাম দেখল অচেনা ছেলে। রিয়া সেই নাম্বারে কল করে বসল। এই ছেলে কে ও জানে না, হয়তো কিছুক্ষণ কথা বলে মন হালকা করা যাবে। ফোন বেজে উঠলো। রিয়া ভাবল কেটে দেবে, , কিন্তু তখনই অপর প্রান্ত থেকে এক কণ্ঠস্বর ভেসে এলো।
"হ্যালো? কে বলছেন?
গভীর, স্বাভাবিক, কৌতূহলমাখা কণ্ঠ।
-আমি... রিয়া
-কোন রিয়া?
- চিনবেন না।
-আপনি কি আমাকে চেনেন।
-নাহ।
-তাহলে?
-কিছু না।
-আপনি কি কিছু বলতে চাচ্ছেন?
-আমি মিসেস আখতারের নাতনি।
-মিসেস আখতার? দুঃখিত, আমি উনাকে চিনি না।
-আপনি চেনেন না? আখতার এস্টেট? লেক পাড়ের সুন্দর বাড়ি?
-না,মনে হয় ভুল নম্বরে কল করেছেন।
-ওহ,আমি দুঃখিত, আমি মনে করেছিলাম আপনি অন্য কেউ।
-কোনো সমস্যা নেই, যেহেতু কথা শুরু হয়ে গেছে, বলুন তো, এই মিসেস আখতার কে?
-তিনি... আমার দাদী। বিশাল বাড়িতে উনি আর আমি থাকি শুধু।
- কেন আর কেউ নেই?
-না নেই।
-বাকি সবাই কোথায় ?
- সবাই বিদেশে থাকে।
- আপনি দেশে কেন?
-আমি বেড়াতে এসেছি।
- বেড়াতে এসে কেমন লাগছে?
- খারাপ না।
- আচ্ছা রিয়া, ভুল নম্বর হলেও কথা বলতে খারাপ লাগছে না।
-দুঃখিত। আপনাকে বিরক্ত করলাম।
-সমস্যা নেই। আমি জায়ান। আপনি যদি আরেকদিন ভুল নম্বরে কল করতে করতে চান , আমি কিন্তু অভিযোগ করবো না। এখন আমাকে রাখতে হবে।
এরপরই লাইন কেটে গেল।
রিয়া ফোনের দিকে তাকিয়ে রইল। ভাবতে লাগল ও আসলে কী করল। কেন একজন সম্পূর্ণ অপরিচিতের সাথে মিথ্যা বলল?
কিন্তু কয়েক মিনিট পর ও অদ্ভুত একটা অনুভূতি টের পেল। আজ অন্তত কিছু সময়ের জন্য রিয়া কেবল একজন কেয়ারটেকার ছিল না। ও ছিল ভিন্ন একটা মেয়ে, যার আলাদা একটা পরিচয় আছে।
ফোনটা পাশে রেখে রিয়া চোখ বন্ধ করল। মিথ্যাটা হয়তো ছোট, তুচ্ছ কিন্তু এর রেশটা অনেক বড়। আজকের রাতের জন্য, প্রথমবারের মতো, রিয়া ছিল অন্য কেউ।
৩।
ফিকে সকালের আলো রিয়া’র ছোট্ট রুমে এসে পড়ল। ঘুম ভাঙল। ক্লান্ত শরীর। আগের দিনের ঘটনাগুলো মুহূর্তেই মনে পড়ে গেল। রিয়ার বুক ধক করে উঠল আবার।
নিজেকে ঝেড়ে ফেলে রিয়া তৈরি হতে লাগল। সময় নষ্ট করার সুযোগ নেই —মিসেস আখতার কি অবস্থায় আছেন কে জানে।
বাড়িটি সব সময়ের মতোই বিশাল। এর উঁচু দেয়ালে রিয়ার দ্রুত পায়ের শব্দ প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল।
রিয়া ভয়ে ভয়ে মিসেস আখতারের রুমে ঢুকল। দরজা খোলার শব্দে তিনি চোখ খুললেন।
‘কিরে ভয় পাচ্ছিস কেন? এদিকে আয়’ মিসেস আখতার ডাকলেন। আজকে তার চেহারার ভেতর মরা লাশ ভাবটা নেই।তাকে শিশুদের মত নিষ্পাপ লাগছে।
‘আমাকে একটু তুলে এই চেয়ারটায় বসিয়ে দে। সকালে এসে বিছানা থেকে তুলে এই চেয়ারটায় বসিয়ে দিবি।এটাই তোর আসল কাজ’
রিয়া মিসেস আখতারের কথামত কাজ করল।
এটা অনেক কাজের একটা চেয়ার। বিদেশ থেকে আমার ছেলে পাঠিয়েছি। বিছানা থেকে নিজে উঠতে পারি না। আরেক জনের ধরা লাগে। তবে চেয়ারটায় একবার বসতে পারলে আমি মোটামুটি চলাফেরা করতে পারি’
উনি চেয়ারে ঠিক হয়ে বসতে বসতে বললেন।
‘তুই এখন যা। আমার জন্য নাস্তা নিয়ে আয়। আমি ফ্রেশ হয়ে নেই।আর তুই এমন ভয়ে জড়সড় হয়ে আছিস কেন? আমাকে এত ভয় পাওয়ার কিছু নেই। মাঝে মধ্যে আমি একটু পাগলামি করি। তখন হুশ থাকে না। অলকা নিশ্চয়ই তোকে তখন ইনজেকশন দিতে হবে তখন বলে গেছে’
অলকা বলতে তিনি আগের মহিলাটাকে বুঝিয়েছেন। রিয়া মাথা নাড়ল।
‘আবার আমাকে বেশি ইনজেকশন দিস না। তাইলে কিন্তু মরে যেতে পারি। অবশ্য ইচ্ছে করলে মেরেও ফেলতে পারিস। একা একা চেয়ার বন্দি জীবন আর ভাল লাগে না’
রিয়ার চোখ ছল ছল করে উঠল। এতদিন মনে হচ্ছিল উঁচু দেয়ালে বন্দি এক জীবন্ত পিশাচ। আজকে মনে হল আসলে মিসেস আখতার আসলে বড্ড একা। অসহায়।
রিয়াকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মিসেস আখতার বললেন, ‘কিরে কিছু বলবি?’
-নাহ।
-তাহলে দাঁড়িয়ে আছিস যে?
-যাই আমি গিয়ে খাবার নিয়ে আসি। বলে বের হয়ে এল। ওর বুক থেকে এই বাড়ি নিয়ে ভয় পুরোপুরি কেটে গেল। যতটা কষ্ট হবে ভেবেছিল আসলে তত কষ্ট নয়। রিয়া তার এই নতুন কাজ এই প্রথম হাসি মুখে মেনে নিল।
রিয়ার নতুন জীবন শুরু হল।কিন্তু শুরুটা খুব একটা ভাল হল না। পরের দিনই হোঁচট খেল। রিয়ার বাবা মারা গেল। খবরটা নিয়ে এল অলকা। বিকেল বেলা। বলল আমি একটা সিএনজি ডেকে দিচ্ছি। তুমি বাড়ি চলে যাও। যেই কদিন থাকার থেকে এস।তুমি আসলে আমি যাব।
নিজের বাপের লাশের চেহারা দেখার ইচ্ছে রিয়ার ছিল না। জানিয়ে দিল ও যাবে না। অলকা যেন ওকে সন্দেহ না করে তাই একটু মিথ্যে বলল। বলল যে রিয়া ওর বাপের আসল মেয়ে না। পালক মেয়ে। এই বাপ মরে গেলে রিয়ার কিছু আসবে যাবে না। অলকা কিছুক্ষণ দুঃখের চোখে তাকিয়ে থেকে চলে গেল।
রাতের বেলা রিয়ার অস্বস্তি হতে লাগল। চোখ বন্ধ হলেই ওর বাপের কথা মনে হছিল। ঘুম আসছিল না। ফোন বেজে উঠল। রিয়া যেন একটা কথা বলার মানুষ পেয়ে হাফ ছেড়ে বাঁচল। স্কিনে জ্বলজ্বল করল অচেনা ছেলে নাম লেখা নাম্বার। ওর সাথে একবার এই নাম্বারে কথা হয়েছিল।
-হ্যালো?
-রিয়া? মিসেস আখতারের নাতনি? রিয়ার মনে পড়ে গেল এর আগে বলা মিথ্যে কথা।
-জি বলুন। আপনি জায়ান।
- বাহ । মনে আছে দেখছি। বিরক্ত করলাম নাত ?
-আগে বলুন কেন ফোন দিয়েছেন। তারপর বলব বিরক্ত হয়েছে কিনা।
কিছুদিন এনজিও তে কাজ করেছিল রিয়া। সেখান থেকে সুন্দর করে কথা বলা রপ্ত করেছে।
-আমি আসলে মিসেস আখতারকে চিনি । সেদিন আপনি হুট করে বলায় বুঝতে পারি নি।
ছেলেটা বলল । রিয়া কি ধরা পড়ে গেল?ভাবল ফোনটা কেটে দেই । কিন্তু শেষটা শোনার জন্য অপেক্ষা করতে লাগল।
-আপনি লেক পাড়ের সুন্দর বাড়িটার কথা বলেছিলেন না? আখতার স্টেট নাম?
-জি। আপনি কিভাবে চেনেন?
-আমি আপনার প্রতিবেশী।ধানমন্ডিতেই থাকি। আমরা লেক পাড়ে আড্ডা দিতাম আর ভাবতাম কারা এই সুন্দর বাড়িটার মালিক। সেখান থেকে জানার চেষ্টা করেছি, আখতার আসলে কে?
-কি জানলেন?
-জানলাম ওনারা বিশাল ধনী । কেউই এখন বাড়িতে থাকেন না। মিসেস আখতার থাকেন শুধু। আর থাকে ভূত।
-ভূত?
-কেন আপনি শোনেন নি? প্রায়ই একটা সাদা শাড়ি পরা মেয়ে বাসার সামনে হেঁটে বেড়ায়।
-আপনি দেখেছেন?
-না। তবে দেখার জন্য অনেক চেষ্টা করেছিলাম। অনেক কষ্টে বাড়ির কাজের লোকের নাম্বার জোগাড় করেছিলাম। কয়েকবার ফোন ও দিয়েছিলাম। কিন্তু ধরে নি।
রিয়া বুঝতে পারল এই ফোনে কিভাবে জায়ানের নাম্বার এল।
-আচ্ছা ভূতের কথা বাদ দিন। রাত হয়ে গেছে,আমার ভয় করবে।
-তাহলে কি দিনে ফোন দেব?
-আরও কথা বলার অজুহাত খুচ্ছেন?
-দা গ্রেট মিসেস আখতারের নাতনির সাথে কথা বলার সুযোগ কে হারাতে চাইবে?
-আচ্ছা আমি এখন রাখি।
-আর একটা কথা?
-বলুন।
-আপনি আমার নাম্বার কোথায় পেলেন?
-ভুলে।
বলে ফোন রেখে দিল। শুরুর দিন একটা অচেনা ছেলের সাথে এত কথা বলা ঠিক হবে না। রিয়া ঘুমানোর চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু ঘুম কি আর আসে? জায়ানের বলা সাদা শাড়ি পড়া ভূতের কথা মাথায় ঘুরতে লাগল। সেটা থেকে মনে পড়তে লাগল বাবার কথা। রিয়া অবাক হয়ে লক্ষ্য করল বাবাকে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলে ওর একটুও খারাপ লাগছে না। মানুষ মারা এত সহজ? বরং ওর ভয় করতে লাগল। চোখ বন্ধ করতেই মনে হল ওর বাবা ওর পাশে এসে বসে আছে। ওর দিকে তাকিয়ে আছে। ভয় মন থেকে দূর করতেই রিয়া জায়ানকে আবার ফোন দিল।
-আপনি আমাকে ভয় পাইয়ে দিয়েছেন। ভূতের ভয়ে এখন কিছুতেই ঘুম আসছে না।
-দুঃখিত। ভয় তাড়ানোর জন্য এখন কি করতে পারি?
ওদের কথা বলা শুরু হল। এরপর থেকে প্রতি রাতেই। দিনের বেলা রিয়া ছিল এক কাজের মেয়ে। রাতের বেলা ও হয়ে যেত এক ধনী পরিবারের রূপবতী তরুণী। এটা ছিল এক ভয়ংকর নেশার মত । এই নেশায় রিয়া নিজেকে হারিয়ে যেতে দিল। খেলাটা শুরু করেছিল মিথ্যে দিয়ে। এর শেষটা ছিল অনেক ভয়ংকর।
রিয়া তখনও তা জানত না।
৪।
দিন যেতে লাগল। রিয়ার জায়ানের সাথে কথা বলা বাড়তে লাগল। প্রতিটি কল যেন ওকে বাস্তবতার দমবন্ধ করা জগত থেকে একটু একটু করে মুক্তি দিচ্ছিল। কিন্তু যতই সে জায়ানের সঙ্গে কথা বলত, ততই এক অপরাধবোধ তাকে কুরে কুরে খেতে লাগল।
ও জায়ানকে মিথ্যা বলেছে। এক মিথ্যে ঢাকতে আরেক মিথ্যে। সেই মিথ্যে ঢাকতে আরেক। এভাবে কতদিন চালান যাবে? কিন্তু রিয়া সত্যি প্রকাশ করতে পারছিল না। অন্তত, তখনো নয়।
এক সন্ধ্যায়, সূর্য দিগন্তের নিচে মিলিয়ে যেতে যেতে আকাশ কমলা আর গোলাপির মিশ্র রঙে রাঙিয়ে দিল। ঠিক তখনই রিয়ার ফোন বেজে উঠল।
ও দ্রুত রিসিভ করল, উত্তেজনায় ওর কণ্ঠ কেঁপে উঠল। “হ্যালো?”
“রিয়া,” জায়ানের চেনা কণ্ঠ ভেসে এল। মাতাল করে দেয় পুরো।
-কেমন আছ রিয়া?
কথা বলতে বলতে কখন যে আপনি থেকে তুমিতে নেমে এসেছে ওরা নিজেরাও জানে না।
-ভাল। তুমি কেমন আছ?
- আমিও ভাল। সারাদিন কোন খোঁজ নেই?
- ব্যস্ত ছিলাম।
রিয়া ইচ্ছে করেই সবসময় একটা ব্যস্ততার ভান করে। এতে অনেক প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়া যায়। ধরা পড়ার ভয় কম থাকে।
-এখনও ব্যস্ত? কথা বলা যাবে?
-অল্প ব্যস্ত তবে কথা বলা যাবে। বলতে থাক।
- আজকে একটা কথা আমার মাথায় ঘুরছে।
- কী কথা?
- আমরা অনেকদিন ধরে কথা বলছি, অথচ এখনো তোমার সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানি না।
-কি বলছো? আমরা তো অনেক কিছু নিয়ে কথা বলেছি।
- হ্যাঁ, কিন্তু সবই এলমেল কথা। তোমার পছন্দ-অপছন্দ, স্বপ্ন—এসব নিয়ে তো কিছুই বলনি।
- বলার মতো কিছু নেই। আমার জীবন খুব সাধারণ।
- আমার মনে হয় না। তোমার মধ্যে কিছু একটা আছে, রিয়া। তুমি অন্যদের চেয়ে আলাদা। আমি সেটা অনুভব করতে পারি।
- জায়ান, তুমি আমার প্রতি এত আগ্রহী কেন? তুমি তো আমাকে দেখ নি।
-হয়তো সেই কারণেই। তুমি একটা রহস্য। আর আমি রহস্য ভালোবাসি।
ওরা কথা বলতে থাকে। যেসব প্রশ্নের উত্তর রিয়ার জানা নেই তা মিথ্যে দিয়ে পূরণ করে দিত। খুবই নিখুঁত মিথ্যে। জায়ান সন্দেহ করছিল না।
-বাবা ইউরোপে একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী । সহজে দেশে আসা হয় না। এই ছুটিতে মার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল।আমিও এলাম। এসে দেখলাম উনি খুব একা। আমার ওনাকে এভাবে রেখে যেতে ইচ্ছে করল না, তাই থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছি, অন্তত ছুটির সময়টা।
জায়ান মনোযোগ দিয়ে শুনত,
-ঈশ তোমার মনটা কত নরম।একা একা সারাদিন এত বড় বাসায় কি কর?
-দাদুর সাথে গল্প করি, ওনাকে গল্পের বই পড়ে শোনাই।
-তুমি ঘুরতে বের হও না?
-নাহ । বাবা কঠিন শর্ত দিয়ে গেছেন। বাংলাদেশের রাস্তাঘাট নিরাপদ না। বাইরে যাওয়া যাবে না।
-তোমার ফেসবুক আইডি নেই?
- আমি আসলে অনেক ব্যস্ত থাকি। চালানোর সুযোগ পাই না।
- কি নিয়ে এত ব্যস্ত থাক?
- ছুটিটা আমি কাজে লাগাতে চাই। তাই একটা এনজিওর সাথে কাজ করছি। ওটা নিয়ে ব্যস্ত থাকি।বিদেশে এনজিও তে কাজ করা অনেক পছন্দ করে।
- এই বয়সে এনজিওতে কাজ?
- আরেহ ওই কাজ না। আমার এক খালাত বোন কাজ করে। আমি বসে বসে ওদের কাজ দেখি।
-তুমি না বাইরে বের হও না।
- সব কাজ কি বাইরেই করা লাগে নাকি। ঘরে বসে অনেক কাজ করা যায়।
রিয়া কিছুদিন বিভিন্ন বস্তিতে একটা এনজিও কে সাহায্য করার কাজ করেছিল। সেই গল্প গুলোই বানিয়ে বানিয়ে বলতে থাকে। জায়ান শোনে আর মুগ্ধ হয়। এত ছোট একটা মেয়ে। কত নরম তার মন। কত ভাবনা তার জীবন নিয়ে। জায়ানের মুগ্ধতা দেখে রিয়া আরও আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠে । এটি ছিল এক রোমাঞ্চকর অনুভূতি—ভয় ও উত্তেজনার মিশেল, যেন ও সরু দড়ির ওপর হাঁটছিল, সত্য ও মিথ্যার মাঝখানে দুলছিল।
ওদের সম্পর্কের টান ধীরে ধীরে বেড়ে যায়। রিয়া বুঝতে শুরু করে জায়ান আসলে একটু বোকা। সহজে মানুষকে বিশ্বাস করে ফেলে। সেদিন রাতে কথা বলতে বলতে ফজরের আজান পড়ে গেল। রিয়া চমকে উঠল। এর আগে এত কথা কখনো বলে নি।
-সে কি । আযান দিয়ে দিল। ইশ। বড্ড দেরী হয়ে গেল। তুমি ঘুমুবে না?
- না আর ঘুমাব না। সকাল ৮ টায় আমার একটা ইম্পরট্যান্ট মিটিং আছে। এখন ঘুমুলে আর ধরতে পারব না।
জায়ান লাজুক কণ্ঠে উত্তর দিল।
- তো তুমি আমাকে বলবে না?
- আসলে তুমিত এত কথাত কখনো বল না। আজকে বললে। তোমার কথা শুনতে ভাল লাগছিল। থামাতে ইচ্ছে করছিল না।
- এসব পাগলামির কোন মানে হয়?
- তোমার জন্য হলামই বা একটু পাগল।
- পাগলামি করবে না। আমার পাগলামি ভাল লাগে না।
-তাহলে কি করব?
-ফোন রেখে ঘুমাও ।
বলে রিয়া ফোন রেখে দিল। ফোন রাখার সাথে সাথে ওর বুকের ভিতর হু হু করে উঠল। মনে হচ্ছিল ইশ ফোনটা যদি রাখতে না হত? যদি অনন্তকাল ও জায়ানের সাথে কথা বলে যেতে পারত।
সেদিন রিয়া প্রথমবারের মত অনুভব করে ও জায়ানকে ভালবেসে ফেলেছে। আর এই ভালবাসার জন্য ও যে কোন কিছু করতে রাজি আছে।
৫।
একদিন রিয়ার মা রিয়াকে দেখতে এল। দেখে মনে হল তিনি অনেক খুশি। স্বামী হারানোর কষ্ট তার চেহারায় নেই।
-মা তুমি এত সেজেছ কেন ?
- কই সাজলাম?
- তোমাকে এত সাজতে কখনো দেখে নি।
মায়ের কথা বার্তায়ও পরিবর্তন দেখল। আগে মা এত কথা বলত না। চুপচাপ থাকত । এখন সবকিছুতেই মন্তব্য করতে লাগল।
‘ মানুষ কত বড়লোক হতে পারে রে। এই বাড়িতে না আসলে বুঝতাম না’
‘তুইত বলেছিলি বুড়ির ব্যবহার খারাপ। আমার সাথেত ভাল ব্যবহার করল’।
‘তোর চোখের নিচে এত কালি কেন? রাতে ঘুমাস না’।
একবার রিয়া বলেই ফেলল, মা তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে না তোমার জামাই মারা গেছে। তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তোমার নতুন বিয়ে হইছে ।
-কি যে বলিস না তুই।
মা লাজুক মুখে হাসে। মায়ের এই হাসি মাখা মুখ রিয়ার বড্ড ভাল লাগে। রিয়া কি তাহলে যা করছে তা কি ঠিক করছে? বাপকে খুন করা নিয়ে রিয়ার মনের মেঘ কেটে যেতে শুরু করে।
মা কিছু সিরিয়াস কথাও বলল,
-তোকে দেখে মনে হচ্ছে তুই এখানে মানিয়ে নিছিস।
- হুমম মা। খারাপ লাগে না এখন।
-বাড়ি যাবি না?
-বুড়ি কে একা রেখে কেমনে যাই?
- পড়াশুনা শুরু কর আবার। তুইত ভাল ছাত্রী ছিলি।
-দেখি।
-তুই কি প্রেম করিস?
রিয়া চমকে উঠল। এই প্রশ্ন আশা করে নি।
-তোকে দেখে মনে হচ্ছে তুই বাস্তবে নাই । একটা ঘোরের মধ্যে আছিস। বার বার ফোনের দিকে তাকাস । কারো ফোনের জন্য অপেক্ষা করিস মনে হয়।
-এটা এই বাড়ির ফোন। ওনার ছেলে মেয়েরা ফোন করে। না ধরলে রাগ করে।
-যাই হোক। যা করার ভেবে চিন্তে করিস। ভুল করিস না। মা হিসেবে হয়ত আমি তোর জন্য অনেক কিছুই করতে পারি নাই।কিন্তু আমি সবসময় তোর পাশে আছি। এটা মাথায় রাখিস।
রাতে মা চলে গেলেন। সারাদিন মা থাকায় জায়ানের সাথে কথা হয় নি। ও বেশ কয়েকবার ফোন দিয়েছিল। মা থাকায় ধরে নি।রিয়া ভাবল হাতের কাজগুলো শেষ করে একবারে জায়ানকে ফোন দেবে।কাজ শেষ করার আগেই একটা মেসেজ আসল।
‘একটু কি বাইরে আসবে? আমি তোমার বাসার সামনে।’
রিয়া হচকচিয়ে গেল। সাথে সাথে জায়ানকে ফোন দিল।
-তুমি আমার বাসার সামনে কেন এসেছ?
-সারাদিন কোন খোঁজ নেই। ভাবলাম কোন বিপদ হল কি না।
-বিপদ হলেই আমার বাড়িতে চলে আসতে হবে?
-না মানে টেনশন হচ্ছিল।
-তোমাকে আমার জন্য টেনশন করতে কে বলেছে?
-তাহলে ফোন ধর নি কেন সারাদিন?
-তোমার ফোন ধরতে কি আমি বাধ্য?
জায়ান ফোন কেটে দিল। রিয়া হাফ ছেড়ে বাঁচল। রিয়া ইচ্ছে করেই রেগে যাওয়ার ভান করল।এরকম হুট করে জায়ানের সামনে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। ধরা পড়ে যেতে পারে। রাগ করল যেন জায়ান ভয় পেয়ে চলে যায়। হয়েছেও তাই। জায়ান চলে গেল। এর আগেও বেশ কয়েকবার জায়ান দেখা করতে চেয়েছিল। রিয়া বিভিন্ন অজুহাত এ এড়িয়ে গেছে। ও আসলে একটু সময় চায়। এমন ভাবে জায়ানের সামনে যেতে চায় যেন কোন ভাবেই বুঝতে না পারে ও আসলে একটা কাজের মেয়ে, বড়লোকের মেয়ে নয়।
রিয়ার ফোনে একটা মেসেজ এল,
‘রিয়া আজ ছিল আমার জর্মদিন। সারাদিন অনেক ভালবাসা, অনেক শুভকামনা পেয়েছি। কিন্তু তোমার কণ্ঠ শুনতে পেলাম না। কিছুতেই মনে শান্তি পাচ্ছিলাম না। সারাদিন অনেকভাবে চেষ্টা করলাম। কিন্তু তোমাকে পেলাম না। রাতে আর মন মানল না। তোমার কাছে চলে গেলাম। বুঝতে পারছি একটু বাড়াবাড়ি করেছি। তোমাকে না বলে এভাবে যাওয়া উচিত হয় নি।প্লিজ তুমি বিষয়টা অন্যভাবে নিও না। তুমি যখন ফ্রি হবে ফোন দিও। আমি অপেক্ষায় থাকব’
মেসেজটা পেয়ে রিয়ার ভেতরটা ওলট পালট হয়ে গেল। ইচ্ছে করল এখনি গিয়ে মানুষটাকে একটু জড়িয়ে ধরে। ইশ জর্মদিনে ওর সাথে কি খারাপ ব্যবহার না করল। রিয়া ওর ঠিক করে রাখা সব বিষয় ভুলে গেল। কাঁপা কাঁপা হাতে মেসেজের উত্তর লিখল,
-তুমি এখন কোথায়?
-লেকের পাশে ।
-কতক্ষণ থাকবে?
-কেন?
রিয়া আর কোন উত্তর দিল না। ফোন রেখে দিল। দ্রুত পায়ে মিসেস আখতারের রুমে প্রবেশ করল। মিসেস আখতার ঘুমুচ্ছে । রিয়া নিঃশব্দে ঘুমের ইনজেকশনটা তুলে নিল। মিসেস আখতারকে ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে দিল।আজকের রাতটা অনেক দীর্ঘ হবে। রিয়াকে অনেক কাজ করতে হবে। এর মাঝে যদি মিসেস আখতার জেগে ওঠে তাহলে রিয়ার কাজে ব্যাঘাত ঘটবে।
মিসেস আখতারের ঘুমিয়ে থাকাই ভাল।
৬।
রিয়া ঝটপট তৈরি হয়ে গেল। মিসেস আখতারের আলাদা একটা রুম আছে। সাজগোজের জন্য। ওনার জামা কাপড় আর সাজগোজের জিনিস রাখা। অল্প বয়সে হয়ত খুব ব্যবহার করতেন। এখন বুড়ো হয়ে গেছেন। এসব আর লাগে না।রিয়া আগে কয়েকবার ওই রুমে গিয়েছিল। একবার একটু চুরি করে সাজগোজও করেছিল। জিনিসপত্র খুঁজে পেতে তাই ওর খুব বেশি সময় লাগে নি। পোশাক হিসেবে বেছে নিল একটা নীল রঙের শাড়ি। ঘর সাজানোর জন্য এ বাড়িতে প্রতিদিন এ তাজা কিছু ফুল আসে। সেখান থেকে একটা ফুল নিল, বাড়ি থেকে বের হল। লেকটা এই বাড়ির কাছেই। লেকের পাড়ে যেতে রিয়ার খুব একটা সময় লাগল না। কিন্তু জায়ানকে খুঁজে পেল না। রিয়া ফোন দিল।
-হ্যালো জায়ান তুমি কি এখনো লেকের পাড়ে?
- হা
- কোথায় আমিত দেখছি না।
-তুমিও কি লেকের পাশে?
-হা
-দেখ এমনিতেই মন ভাল নেই আমার। এখন মজা কর না।
-আমি মজা করছি না।
-এত রাতে লেকের পাড়ে তুমি কেন আসবে?
-তোমার সাথে দেখা করতে।
-সত্যি করে বলত তুমি কোথায়?
-তুমি ব্রিজটার কাছে এস। তাহলেই বুঝতে পারবে। নীল শাড়ি পরা মেয়েটা আমি।
রিয়া ফোন রেখে দিল। জায়ানের কণ্ঠে অবিশ্বাস।
রাত ১১ তা বাজে। এত রাতে একটা মেয়েকে একা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অনেকেই সন্দেহের চোখে তাকাচ্ছে। রিয়ার অস্বস্তি হতে লাগল। চারপাশটা কেমন ঠাণ্ডা। বৃষ্টি হবে কি? আজকাল অবশ্য প্রায়ই বৃষ্টি হচ্ছে।
“এই তুমি কি রিয়া?”
রিয়া ঘুরে দাঁড়াল। ফর্মাল শার্ট প্যান্ট পরা, ক্লিনশেভ করা একটা ছেলে। ভালই লম্বা, মাঝারি স্বাস্থ্য। দেখতে শুনতে মন্দ না। দেখে মনে হচ্ছে কোন চাকুরীর পরীক্ষা দিতে যাচ্ছে। রিয়া অবশ্য কণ্ঠ শুনে একটু বাচ্চা বাচ্চা কল্পনা করেছিল। কিন্তু এই চেহারাও খারাপ না।রিয়া ফুলটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
“শুভ জর্মদিন জায়ান।”
জায়ান যেন এখনো বিশ্বাস করতে পারছে না।
-তুমি মানে, এত রাতে? ফুল নিয়ে ? শাড়ি পরে ?
-আমি কখনো শাড়ি পরিনি। তোমার জর্মদিন দেখে পরলাম।
-আমিত ভাবতেও পারছি না…
-ভাবা ভাবির অত দরকার নেই। আগে বল আমাকে কেমন লাগছে?
জায়ান ধাতস্থ হতে কিছুটা সময় নিল। তারপর বলল,
-কল্পনার চেয়েও সুন্দর বলে একটা কথা আছে। এতদিন বিশ্বাস করিনি। আজ তোমাকে দেখে প্রমাণ পেলাম।
- তোমার মন ভাল হয়েছে?
- খুব।
-তাহলে আমি এখন আসি?
-এখনি চলে যাবে?
-থাকতে বললে কিছুক্ষণ থাকব। তোমার জর্মদিন বলে কথা।
- তাইলে চল কিছুক্ষণ বসি।
-আচ্ছা।
-এখানেই বসবে?
-তোমার ইচ্ছে।
- আমার সাথে গাড়ি আছে। তাইলে চল সুন্দর কোথাও গিয়ে বসি। এই জায়গাটা রাতে নিরাপদ না।
- ঠিক আছে।
-আমার সাথে গাড়িতে যেতে তোমার আপত্তি নেইত?
-মাঝরাতে যদি দেখা করতে আসতে পাড়ি, গাড়িতে উঠতে আর কি সমস্যা।
রিয়া মিষ্টি করে হাসল। জায়ানের মনে হল যেন পৃথিবীর সমস্ত সৌন্দর্য রিয়ার মুখে এসে ভর করেছে।
ওরা গাড়িতে উঠতে যাবে এমন সময়ে বৃষ্টি নামল।জায়ান দ্রুত গাড়ির দরজা খুলে দিল। রিয়া গাড়িতে উঠল না।দাঁড়িয়ে রইল।
-উঠে পড়।
-আমি উঠব না।
- কেন? ভিজে যাচ্ছত ।
- আমি বৃষ্টিতে ভিজব।
-এখন? এত রাতে?
- হুমম। তুমি কি আমার সাথে ভিজবে?
ওরা দুইজন বৃষ্টিতে ভিজতে লাগল। কিছুক্ষণ পর জায়ানের হাঁচি শুরু হল।
-সরি। আমার আবার বৃষ্টিতে অ্যালার্জি আছে।একটু ভিজলেই হাঁচি শুরু হয়।
-তো তুমি আমাকে বলবে না?
-বললেত আর তোমার সাথে ভেজা হত না।
-তাই বলে নিজের ক্ষতি করবে?
-যেই প্রেম এত সুন্দর একটা রাত উপহার দিতে পারে তার জন্য আমি ধ্বংসও হয়ে যেতে পাড়ি।
বলতে বলতে জায়ানের গলা ধরে এল। রিয়া অবাক হয়ে জায়ানের দিকে তাকিয়ে রইল। এত বোকাও মানুষ হয়?
৭।
রিয়ার জীবন যেন আচমকা বদলে গেল। এতদিন শুধু ফোনে কথা হত। বাকি সব কিছু ছিল কল্পনা।সব কিছু সত্যি না এমন একটা চিন্তা মাথায় ছিল। রিয়া নিজেকে শান্ত রেখেছিল। কিন্তু জায়ানের সাথে দেখা হবার পর সবকিছু পালটে গেল। ওর মনে হচ্ছিল শুধু জায়ানই সত্য, বাকি সবকিছু তুচ্ছ। নিজেকে আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে রিয়া নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করে,
‘জায়ান এখনো তোর আসল পরিচয় জানে না। জানলে তোদের সম্পর্ক আর থাকবে না।’
পরক্ষনেই আবার মনে হয়, প্রেমের কারণে কত অসম্ভবই না ঘটে। জায়ান হয়ত ওর সত্যটা জানার পরও মেনে নেবে। আবার রিয়া নিজেকে বলতে থাকে,
‘তুই একটা খুনি। নিজের বাপকে খুন করছিস ।পাপ করছিস। এই পাপের জীবনে জায়ানকে জড়ানোর চেষ্টা করিস না । দুজনেই ধ্বংস হয়ে যাবি’
রিয়া নিজের সাথে বোঝাপড়া করার চেষ্টা করে। অন্য কাজ করার চেষ্টা করে। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয় না। সারাক্ষণ ওর মাথার মধ্যে শুধু জায়ানের কথা ঘুরতে থাকে। মনের মধ্যে এক তীব্র অস্থিরতা। মনে হচ্ছে জায়ানের একটু কাছে না গেলে, ওর কথা না শুনলে, ওর একটু ছোঁয়া না পেলে রিয়া দম বন্ধ হয়ে মারা যাবে। জায়ানের সাথে দেখা হবার সময় ওর যে ঘ্রাণ রিয়ার নাকে এসেছিল, সেই ঘ্রাণ ওর চারপাশে ছড়িয়ে থাকে। কোন কাজে মন নিতে পারছিল না। কাজ কর্মে শুধু ভুল হতে থাকে । সবচেয়ে বড় ভুল যেটা করল সেটা হল মিসেস আখতারকে ভুল ওষুধ খাইয়ে দিল। তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লেন। শ্বাসকষ্ট শুরু হল। দেখে মনে হচ্ছিল এখনি মারা যাবেন। ওর কাছে মিসেস আক্তারের দেখাশোনা করা ডাক্তার এর নাম্বার দেয়া ছিল। রিয়া সেই নাম্বারে ফোন দিল। সাথে সাথে হুলস্থূল লেগে গেল। একের পর এক লোক আসতে শুরু করল বাসায়। মিসেস আখতারকে হাসপাতালে নেয়া হল না। বরং পুরো বাসাটাকেই যেন হাসপাতাল বানিয়ে ফেলা হল। অতিরিক্ত টাকা থাকলে যা হয় আর কি। ওনার ছেলে মেয়েরা একের পর এক ফোন দিতে লাগল। মিসেস আখতার সুস্থ হয়ে উঠলেন । রিয়া খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিল। ভাগ্য ভাল কেউ রিয়াকে সন্দেহ করল না। বরং ঠিক সময়ে ডাক্তারকে ফোন দেয়ার জন্য একের পর এক ধন্যবাদ পেতে লাগল। ও হাফ ছেড়ে বাঁচল। রিয়া বুঝতে পারল জায়ানের সাথে দেখা না হলে ওর এই অস্থিরতা কমবেনা। সেদিন বিকেলেই রিয়া জায়ানের সাথে আবার দেখা করল। পড়ন্ত বিকেলে ওরা একটা কফি হাউজে বসল। জায়ান রিয়াকে দেখে বলল, তোমাকে খুব ক্লান্ত লাগছে।
-লাগতে পারে। আমার ভাল লাগছে না।
-কেন?-জানি না । কেন যেন খুব অস্থির লাগছে।
-কোন কিছু নিয়ে চিন্তা করছ?
-নাহ। তেমন কিছু না।
-তাহলে?
-আমার কিছু একটা করতে মন চাচ্ছে।
-কি করতে ইচ্ছে করছে?
-ইচ্ছে করছে রিক্সা করে খোলা বাতাসে একটু ঘুরে বেড়াই।
-তাহলে চল ঘুরে বেড়াই।
-ইচ্ছে করলেই সব কিছু করতে হবে নাকি?
-যদি সামর্থ্য থাকে তাহলে করা উচিত।
-আমারত আরও অনেক কিছুই করতে ইচ্ছে করে।
-কি কি করতে ইচ্ছে করে ?
-তোমাকে বলে কি লাভ?
-শুনে রাখি। যদি সামর্থ্যে থাকে পূরণ করার চেষ্টা করব।
-বাদ দাও। তোমার কথা বল।
-আমার কি কথা?
-আজকে সারাদিন কি করলে?
-কিছু করিনি।
-অফিস যাও নি?
-নাহ।
-কেন?
-ইচ্ছে করল না।
-তাহলে কি করেছ?
-সত্যিটা শুনতে চাও?
-হুমম বল।
-সারাদিন শুয়েছিলাম।
-কেন ? শরীর খারাপ?
-নাহ।
-তাহলে?
-আসলে শুয়ে শুয়ে তোমার কথা ভাবছিলাম। আমার খুব ভাল লাগছিল।
রিয়া শব্দ করে হেসে উঠল। অপ্রকৃস্থের মত হাসি। যেন এমন মজার কথা ও আর এ জীবনেও শোনে নি।
এর কিছুদিন পর ও যখন নিজ হাতে আখতার স্টেট আগুনে পুড়িয়ে দিচ্ছিল, সেদিন এই বিকেলটার কথা রিয়ার খুব মনে পড়ছিল।
৮।
প্রেমে পড়াটা কেমন যেন, নিজের উপর কোন নিয়ন্ত্রণ থাকে না। অন্তত রিয়ার তাই মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে একটা অদৃশ্য সুতো দিয়ে ওর হাত পা বাঁধা, ওকে যা বলছে তাই করতে হচ্ছে। ওর নিজের কোন ইচ্ছে নেই। এটা কি ভাল হচ্ছে না খারাপ হচ্ছে ঠিক বুঝতে পারছে না। ওর মাথা কোন কাজ করছে না। রিয়া বরং নিজেকে ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দিল। দেখা যাক এত আবেগ কোথায় নিয়ে দাঁড় করায়। তবে রিয়ার একটা জিনিস ভাল লাগছিল। ওর দিনগুলো কাটছিল স্বপ্নের মত। একেকটা দিন যাচ্ছিল আর ও জায়ানের আরও কাছে চলে যাচ্ছিল। সকালে ঘুম থেকে উঠত। যত দ্রুত সম্ভব ঘরের কাজ গুলো শেষ করে ফেলত। তারপর জায়ানের জন্য অপেক্ষা। প্রায়ই ওরা ঘুরতে বের হত। মিসেস আখতারকে ঘুমের ওষুধ দেওয়ার মাত্রাও অনেক বেড়ে গেল। একদিন তিনি সন্দেহ করে বসলেন,
-রিয়া তুই কি আমাকে এরমধ্যে ঘুমের ওষুধ দিয়েছিলি?
রিয়া কিছুটা থতমত খেয়ে গেল। কি ওষুধ খাচ্ছে না খাচ্ছে এসব নিয়ে মিসেস আখতার খুব একটা মাথা ঘামান না। রিয়া এই সুযোগটাই নিচ্ছিল। তাইলে কি ও ধরা পড়ে গেল?
-কই নাত।
-তাইলে মনে হয় আমারই ভুল হয়েছে।
- কি ভুল?
-আমার হিসেবে আজকে ২৫ তারিখ। কিন্তু আসলে আজকে ২৭ তারিখ। মাঝখানে দুই দিন নেই।
- আপনার হিসেবে ভুল হতে পারে।
-এই হিসেবে আমার ভুল হয় না। ২৭ তারিখ আমার বড় মেয়ের জর্মদিন। আমার সবসময় মনে থাকে।আমি কি আজকাল একটু বেশি ঘুমাই? দিন তারিখ কেমন এলমেল লাগে।
- হতে পারে। আপানাকে একটা নতুন ইনজেকশন দেয়া হচ্ছে। ডাক্তার আমাকে বলেছিল। একটু বেশি ঘুম হতে পারে এজন্য।
সুযোগ পেয়ে রিয়া মিথ্যে বলে দিল। মিসেস আখতার আর কিছু বললেন না। রিয়ার সাহস আরও বেড়ে গেল। এরপর একদিন ও জায়ানের সাথে বের হল। রাতে আর ফিরল না। ওরা দুজন একসাথে থাকল। জায়ান কয়েকদিনই বলেছিল রিয়া চাইলে ওর ফ্ল্যাটে যেতে পারে। ওখানে কেউ থাকে না। ওরা চাইলে ওখানে নিরিবিলি সময় কাটাতে পারে।রিয়া এড়িয়ে যেত। প্রেমিকের সাথে ফাঁকা ফ্ল্যাটে যাওয়ার অর্থ ও জানত। কিন্তু জায়ান এত হালকা ভাবে কথাটা বলত। যেন এটা ওদের জন্য খুবই সাধারণ একটা ঘটনা। অন্যভাবে নেওয়ার কিছু নেই। সেদিন রিয়া রাজি হয়ে গেল। এত কিছুই যখন হচ্ছে তখন আর এই দূরত্ব রেখে কি লাভ?
জায়ানের ফ্ল্যাট ছোট কিন্তু সুন্দরভাবে সাজানো। হালকা রঙের দেয়াল। একটা ছোট্ট বুকশেলফ। এক কোণায় রাখা একটা গিটার, আর সাইড টেবিলে তার মায়ের একটা ছবি—সবকিছু খুব ছিমছাম ।
"খুব সুন্দর," রিয়া বলল। ভেতরে ভেতরে একটু অস্বস্তি বোধ করছিল ও।
"এটাই আমার পৃথিবী," জায়ান হেসে বলল। ওকে সোফার দিকে নিয়ে বসতে বলল। ওরা খুব কাছাকাছি বসল। ওদের শরীর একে অপরকে ছুঁয়ে গেল। জায়ানের শরীর থেকে আসা সুগন্ধ রিয়ার শ্বাস বাড়িয়ে দিচ্ছিল ।
"তুমি অনেক চুপচাপ হয়ে গেছো," জায়ান চিন্তিত কণ্ঠে বলল। "সব ঠিক আছে তো?"
"আমি... আমি ঠিক আছি," রিয়া মিথ্যা বলল। কিছু একটা ওকে চেপে ধরছিল। রিয়া চাইছিল কিছু হবার আগে নিজের সত্যটা জায়ানকে বলে দিতে। কিন্তু ওর গলা দিয়ে কোন কথা বের হচ্ছিল না।
জায়ান যেন বুঝতে পারল রিয়াকে। ওর হাত চেপে ধরে বলল, "তুমি জানো, তুমি আমাকে সব বলতে পারো। আমি তোমার জন্য আছি।"
রিয়ার মন নীরব চিৎকার করে উঠল । এত ভালোবাসার যোগ্য কি ও ?
"আমি তোমাকে কিছু বলতে চাই," রিয়া ধীরে ধীরে বলল।
"কি ব্যাপার?"
কথাগুলো আটকে গেল।
কথার পরিবর্তে, রিয়া হঠাৎ ঝুঁকে এসে জায়ানকে চুমু খেল।
এটা ছিল হঠাৎ, আবেগী—একটা নীরব স্বীকারোক্তি।
জায়ানও সাড়া দিল।তার হাত রিয়ার মুখ ছুঁয়ে রইল। চুমু গভীর থেকে গভীরতর হলো। এক মুহূর্তের জন্য, রিয়া সব ভুলে গেল—ভয়, মিথ্যা, সংশয়।ওদের ছোঁয়ায় যেন আগুন লেগে গেল। আত্মসমর্পণের সব সীমা উড়ে গেল। প্রতিটি ছোঁয়া এক অব্যক্ত ভালবাসা হয়ে উঠল।জায়ান যেন ওকে নতুনভাবে ভালোবাসতে শিখাল। সেই রাতে, রিয়া নিজেকে বিশ্বাস করতে চাইল—বিশ্বাস করতে চাইল যে সে সত্যি ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য।
পরক্ষণে, ওরা দুজনেই বিছানায় পাশাপাশি শুয়ে ছিল। ওদের নিঃশ্বাসের শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ ছিল না ঘরে।সেই রাতে রিয়া আর কিছু বলার সুযোগ পেল না। জায়ানই কথা বলতে লাগল। একে একে খুলে বলল ওর সব।
"আমি, আমার পরিবার নিয়ে তেমন কথা বলি না," জায়ান গভীর নিঃশ্বাস নিল। "আমার মা... তিনি আমার সবকিছু। বাবা আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছিল যখন আমি খুব ছোট ছিলাম। আমি তাকে মনে করতে পারি না।"
রিয়ার বুকটা হালকা মোচড় দিল।
"আমার মা অনেক কষ্ট করে আমাকে বড় করেছেন," ওর গলা ধরে এল। "আমি যা করি, সব তার জন্য করি। আর এখন… তোমার জন্যও।"
ও রিয়ার দিকে তাকাল। জায়ানের চোখে ভালোবাসার জল ।
"তুমি আমার জীবনের অনেক জায়গা নিয়ে গেছ, রিয়া।আমি তোমাকে ভালোবাসি।"
ওর কথাগুলো যেন তীরের মতো ঢুকল । রিয়া একসাথে আনন্দ ও অপরাধের বোধ অনুভব করল।
"আমি চাই আমরা সারাজীবন একসঙ্গে থাকব" জায়ান ফিসফিস করে বলল।
রিয়া কথা বলতে পারছিল না।
নিজের সত্যের মুখোমুখি হওয়ার বদলে, ও জায়ানের চোখের দিকে তাকিয়ে কাঁপা কণ্ঠে বলে উঠল—
"আমিও তোমাকে ভালোবাসি।"
জায়ান হাসল। ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল।
জড়িয়ে ধরেই বলল, ‘রিয়া?’
রিয়া আবেশ ভরা কণ্ঠে বলল, ‘হুমম’
‘আমার মা কিন্তু ভালবাসা দেখতে পারে না।’ যেন লুকিয়ে রাখা কিছু বলল জায়ান।
‘কেন?’ রিয়া জায়ানের হাতের আঙ্গুল নিয়ে খেলা করছিল।
‘ওনার প্রেমের বিয়ে ছিল। কিন্তু ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। ভরসা পান না তাই’ জায়ানের কণ্ঠে ভয়।
‘তাই তুমি এতদিন প্রেম কর নি?
‘অনেকটা সেরকমই। উনি এরকম পরিবেশ তৈরি করত আমি এসব থেকে দূরে থাকতে বাধ্য হতাম’
রিয়া জায়ানের চোখে চোখ রাখল, ‘তুমি কি তাহলে আমার থেকেও দূরে চলে যাবে?’
রিয়ার কপালে একটা আলতো করে চুমু খেল, ‘কখনো না। তোমাকে আমি হারাতে পারব না। কিন্তু একটা কথা।’
‘কি কথা।’ কিন্তু শব্দটাকে ভয় পায় রিয়া।
‘আমাদের সম্পর্কের কথা জানাজানি হলে মা হয়ত চেষ্টা করবে বাধা দিতে।’ একটু থামল জায়ান। তারপর বলল, ‘বাঁধা দিলে তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যাবে নাত?’
রিয়া জায়ানকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরল, ‘কখনো না।’
৯।
পরের দিন সকাল। জায়ানের ফ্ল্যাটের জানালা দিয়ে সূর্যের হালকা আলো ঢুকল। ঘরটিকে এক কোমল আভায় ভরিয়ে তুলল। রিয়া ধীরে ধীরে জেগে উঠল। ও এখনো জায়ানের বাহুতে জড়িয়ে আছে। কালকে রাত তা অনেক সুন্দর ছিল।যেন এই নিষ্ঠুর পৃথিবী থেকে অনেক দূরে। অন্য কোন ভুবন। যেখানে শুধু জায়ান আর রিয়া। আর কোন কিছুর স্থান নেই।
ধীরে ধীরে রিয়া বাস্তবে ফিরে এল। চোখ আলোতে অভ্যস্ত হলো। বাস্তবতা আবারও মনের গভীরে ফিরে এলো। আগের রাতের আনন্দ এখন এক নতুন দুশ্চিন্তার ছায়ায় ঢাকা পড়ল —রিয়া অনেক দূর চলে এসেছে। ওর আর ফিরে যাবার পথ নেই।
জায়ান পাশেই নড়েচড়ে উঠল। ঘুম ভাঙা চোখে তাকিয়ে হালকা হাসল। আলতো করে রিয়ার চুল সরিয়ে দিয়ে বলল,
“শুভ সকাল ”
“শুভ সকাল” রিয়া ফিসফিস করে জবাব দিল।
জায়ান ওর কপালে একটি চুমু খেয়ে উঠে বসলো। আড়মোড়া ভাঙল। তারপর বলল, “তুমি শুয়ে থাকো, আমি কফি নিয়ে আসছি।”
রিয়া মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। চুপচাপ ওকে যেতে দেখল। ও চাদরটা শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। মনে মনে দ্রুত চিন্তা করতে লাগল। ওকে কিছু একটা করতে হবে। যত বেশি সময় ও এই মিথ্যাকে টেনে নিয়ে যাবে, ততটাই বিপদে পড়বে। সত্যটা একদিন প্রকাশ পাবেই।
কিন্তু আসলেই কি তাই? রাতে জায়ানের কথা শুনে মনে হল, ও ওর মাকে ভয় পাচ্ছে। মা যেন কোন বাঁধা দিতে না পারে তাই ওদের সম্পর্কটা গোপন রাখছে। আর যদি গোপন থাকে তাইলে রিয়ার ভাল। জায়ান ওর সম্পর্কে সত্যটা কখনো জানতে পারবে না। রিয়া যাই বলবে তাই ওকে বিশ্বাস করতে হবে। এই কথা ভাবতেই যেন রিয়ার মনের কাল মেঘ দূরে সরে গেল।রিয়ার সামনে যেন আরও কতগুলো সম্ভাবনার দুয়ার খুলে গেল। জায়ান শুধু ওর।পুরো পৃথিবী ওর সামনে বাঁধা হয়ে দাঁড়ালেও ও জায়ানকে হারাতে দেবে না।
জায়ান দুটি ধোঁয়া ওঠা কফির মগ হাতে ফিরে এলো। ততক্ষণে রিয়া নিজেকে সামলে নিয়েছে। ওর মনটা খুব ভাল লাগছে।জায়ানের মনে রিয়াকে হারানোর ভয় আছে। এই হারানোর ভয় থাকা মানে জায়ানও রিয়াকে ভালবাসে এবং সেটা খুব গভীরভাবে।
“আমি ভাবছিলাম,” কফির কাপ বাড়িয়ে দিয়ে জায়ান বলল, “আজকে সারাটা দিন একসাথে কাটাই। হয়তো একটু ড্রাইভে বের হবো, শহরের বাইরে কোথাও।”
“তোমারত অফিস আছে” রিয়া বলল। চেষ্টা করল যেন ওর কণ্ঠ উৎসাহী শোনায়।
‘তুমি রাজি হলে ছুটি নিব।’ জায়ান যেন আশার আলো দেখল।
রিয়ার জায়ানের এই খুশি খুশি মুখটা দেখতে ভাল লাগছিল। ওকে না বলতে ইচ্ছে করছিল না।
“কিন্তু আমাকে আগে বাসায় যেতে হবে,” রিয়া বলল, কণ্ঠস্বর দ্বিধাগ্রস্ত হলেও দৃঢ়। “আমাকে আমার দাদিকে বুঝিয়ে বলতে হবে। আমি এতক্ষণ ধরে নেই, উনি নিশ্চয়ই খুব চিন্তা করছেন। আমার ওনাকে বুঝিয়ে বলতে হবে। বের হবার জন্য কোন অজুহাত দেখাতে হবে। তারপর আমরা যেতে পারি।”
জায়ান যেন খুশিতে বাঁধনহারা হল।ওর চোখে আবেগ খেলা করছিল। “অবশ্যই,” জায়ান বলল। “যতটুকু সময় লাগে নাও। আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করব।”
সেইদিন সকালে, রিয়া আখতার এস্টেটে ফিরে গেল। ও দ্রুত কিন্তু সতর্কতার সাথে চলাফেরা করল। সবকিছু ঠিক আছে কিনা নিশ্চিত হল। মিসেস আখতারকে ঠিকমতো খাবার এবং ওষুধ খাওয়ানোর কাজ শেষ করল। এরপর তাকে আবার ঘুম পাড়ানোর ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিল। মিসেস আখতার পুরোপুরি ঘুমিয়ে পড়েছেন এটা নিশ্চিত হয়ে রিয়া নিঃশব্দে বেরিয়ে গেল। ওর হৃদয় উত্তেজনায় দ্রুত স্পন্দিত হতে লাগল।
জায়ান ওকে উজ্জ্বল হাসি দিয়ে স্বাগত জানাল। ওরা গাড়িতে উঠল এবং দীর্ঘ ড্রাইভে বেরিয়ে পড়ল। ঠাণ্ডা বাতাস ওদের মুখে আছড়ে পড়ছিল, শহরের কোলাহল একসময় পিছনে হারিয়ে গেল। সামনে কেবল এক বিস্তৃত পথ, যেন একটি খালি ক্যানভাস। বহুদিন পর, রিয়া নিজেকে মুক্ত অনুভব করল।
ওরা একটি নির্জন লেকসাইড রিসোর্টে থামল। আশেপাশের শান্ত পরিবেশ এর সৌন্দর্য আরও বাড়িয়ে তুলেছিল। জায়ান সব পরিকল্পনা আগেই করে রেখেছিল—একটি আরামদায়ক কেবিন, নরম আলোয় সজ্জিত, জলের ধারে একটি অন্তরঙ্গ খাবার, আর পিছনে বাজছিল মৃদু সঙ্গীত।
“তোমার পছন্দ হয়েছে?” জায়ান জিজ্ঞেস করল, যখন ওরা লেকের ধারে হাঁটছিল। ওর হাত রিয়ার হাতের ওপর আলতোভাবে ছুঁয়ে ছিল।
“আমি ভালোবেসেছি,” রিয়া ফিসফিস করে বলল। চোখে এক অদ্ভুত উজ্জ্বলতা নিয়ে।
এই মুহূর্তে, রিয়া তার সমস্ত গোপন সত্য ভুলে যেতে চাইল। সে চাইল জায়ানের ভালোবাসায় নিজেকে হারিয়ে ফেলতে।
যখন ওরা কেবিনে প্রবেশ করল, মুহূর্তের মধ্যে তাদের মধ্যে থাকা আকর্ষণ এক আবেগের বিস্ফোরণ ঘটাল। জায়ানের স্পর্শ কোমল কিন্তু গভীর, ওর ঠোঁট রিয়ার গলায় আলতোভাবে ছুঁয়ে যাচ্ছিল, যার প্রতিটি অনুভূতি রিয়ার হৃদস্পন্দন দ্রুততর করছিল।
অনেকটা সময় কেটে গেল ফিসফিস করে বলা স্বীকারোক্তি আর জড়িয়ে থাকার মধ্যে। ওদের প্রতিটি স্পর্শ যেন একটি প্রতিশ্রুতি—একটি মরিয়া চেষ্টা, যেন এই ক্ষণস্থায়ী সুখটুকু ধরে রাখতে পারে।
পরবর্তী সময়টুকু ওদের যেন এক স্বপ্নের মতো হয়ে উঠল। ওরা কাছের বাজার ঘুরে দেখল, রাস্তার খাবার খেতে খেতে হাসাহাসি করল এবং লেকের ধারে শান্ত মুহূর্তে বসে থাকল।
জায়ান সুযোগ পেলেই চুপিচুপি রিয়াকে বলতে লাগল ভালবাসি।ওর চোখে একইসাথে দুষ্টুমি আর গভীর ভালোবাসা ঝলসে উঠত।
সত্যিকারের ভালবাসা বুঝি এমনি হয়। কিছু সময় পর পর রিয়ার চোখে পানি আসতে লাগল। ওর মত এক পাপীর কপালে এত ভালবাসা সইবেত?
রিয়ার সন্দেহই সত্য হল। এত ভালোবাসা সইল না। জায়ানের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ও যখন আখতার স্টেটে ফিরে আসল, তখন ওর ফোন একটা মেসেজ এল , ‘জায়ানের সাথে এত তাড়াতাড়ি বিছানায় চলে যাবে ভাবি নি। যাই হোক, সাবধানে থেক।’
মেসেজটি দেখে রিয়ার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে লাগল।
১০ ।
প্রেম করতে গেলে বাঁধা আসবেই। কথাটা লিজা বলত। লিজা ছিল রিয়ার বান্ধবী। নিজ প্রেমের আগে রিয়া লিজার প্রেম দেখেছিল। খুব একটা ভাল লাগে নি। প্রেমের জন্য লিজা খুন হয়েছিল। কিভাবে হয়েছিল ঠিক জানে না। প্রেমিকের হাত ধরে ঘর ছেড়েছিল। তারপর লাশ হয়ে ফিরল। পুলিশ কিছুদিন খোঁজখবর করল। লিজা বা ওর প্রেমিক দুই পরিবার এর কারোরই অত টাকা পয়সা ছিল না।কাজেই পুলিশ খুব একটা উৎসাহ দেখাল না। মামলা ধামাচাপা পড়ে গেল।
সেই দিন গুলোর কথা ওর খুব মনে আছে। লিজার প্রেমিক ছিল বখাটে একটা ছেলে। ওদের সমান বয়স। পড়াশুনা ছেড়ে দিয়েছিল। কাজ করত না। কটকটা রঙের ড্রেস পরে রাস্তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকত। রিয়ার পছন্দ ছিল না। ও প্রায়ই লিজাকে বলত,
-কি দেখে তুই এই ছেলের প্রেমে পড়ছিস বলত?
-প্রেম কি আর এত হিসাব করে হয়।
- কি আমার প্রেম। তার আবার হিসাব নিকাশ।
- নিজেত প্রেম করিস না। তুই কেমনে বুঝবি?
- কাম নাই এসব ফালতু কামে সময় নষ্ট করি।
- কোন দিন প্রেমে পড়। তারপর বুঝবি কোনটা ফালতু আর কোনটা আসল।
সেই রিয়াই প্রেমে পড়েছে। লিজার কথা গুলো সত্য মনে হয়। প্রেমে না পড়লে আসলে প্রেম জিনিসটা বোঝা যায় না। প্রেমের কারণে লিজার জীবন গেল, রিয়ার ও কি যাবে? রিয়া ভেবে পেল না। জায়ান যদি ঘুরতে নিয়ে ওকে মেরে ফেলত? ওর কি কিছু করার থাকত? না মনে হয়।অবশ্য লিজা বলত, ‘তোর সাহস অনেক বেশি, বুদ্ধিও মাশাল্লাহ। তোর কোন বিপদ হবে না। বিপদ হইলে সামলে নিতে পারবি। ’
সামলে নিতে কি পারছে রিয়া? রিয়া মাথা ঠাণ্ডা রাখল। ফোনে আসা মেসেজটা নিয়ে মাথা ঘামাল না। যেই দিয়ে থাকুক, রিয়া চুপ থাকল। কে দিয়েছে সেটা খুঁজতে গেল না। তার দরকার হলে সেই খুঁজে নেবে। রিয়া বরং এমন একটা ভাব করতে থাকে যেন কিছু হয় নি। বাইরে থেকে ফিরে ও ঘরের কাজগুলো ঠিক ভাবে শেষ করল। কাজ শেষ করে ঘুমুতে গেল। রাতে ওর খুব ভাল ঘুম হল।
পরের দিনটি রিয়ার জন্য অন্যসব দিনের মতোই শুরু হল। সকাল সকাল উঠে পড়ল। প্রতিদিনের কাজগুলো শেষ করল।তারপর নিজের মত সময় কাটাতে লাগল। জায়ান আজকে খুব ব্যস্ত। সামনের বেশ কিছুদিন ও ব্যস্ত থাকবে। মার্কেটিং এর কাজে ঢাকার বাইরে গিয়েছে। কাজেই রিয়ার তেমন কিছু করার থাকল না।
সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়ে এল। রিয়ার একটু ঘুম ঘুম ভাব এল। ঘুম তাড়ানোর জন্য রিয়া দোতালার গাছের টবগুলোর যত্ন নিচ্ছিল। এমন সময়ে ইন্টারকম বেজে উঠল।
রিয়া বুক ধক করে উঠল। এই সময়ে এই বাড়িতে কেউ আসার কথা না। রান্না করা, ঘর পরিষ্কার করার জন্য কয়েকজন আসে। ওদের কাছে পেছনের দরজার চাবি দেয়া আছে। ইন্টারকম চাপার কথা না।রিয়া মনের ভেতর বাড়তে থাকা ভয়কে চেপে ধরে রাখার চেষ্টা করল।কণ্ঠটা স্বাভাবিক করে ইন্টারকমে জিজ্ঞেস করল,
-কে?
- আপনি কি রিয়া?
- আপনি কে?
- আমাকে চিনবেন না। আমি রিয়ার সাথে কথা বলতে চাচ্ছিলাম।
- কি কথা।
- সেটা রিয়াকেই বলব।
রিয়া ইন্টারকম অফ করে দিল।সামনে এগিয়ে গেল।
গেটের বাইরে ছিল এক ছেলে, ও চেনেনি। পরনে ছিল জিন্স, কলারওয়ালা শার্ট। ভাব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
"তুমি রিয়া?" গেটের পাশে হেলান দিয়ে প্রশ্ন করল।
"হ্যাঁ। তুমি কে?" ছেলেটা তুমি বলায় রিয়াও তুমিতে নেমে এল। সমানে সমান থাকার চেষ্টা।
"আমি তানিম," ও হাসল।
‘ দুঃখিত আমি চিনতে পারলাম না’ রিয়ার সাবলীল উত্তর।
"জায়ানকেত চেন? আমি জায়ানের বন্ধু "
জায়ানের নাম শুনে রিয়ার পেটের ভেতর কেমন যেন মোচড় দিয়ে উঠল। সে গেটটা শক্ত করে ধরে ফেলল, গলা স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করল। "নাহ চিনি না"
"তোমার অবশ্য চেনার কথা না।" তানিম হালকা সুরে বলল, তবে ওর কণ্ঠে এমন কিছু ছিল যা রিয়াকে অস্বস্তিতে ফেলল। "তুমি এই বাড়িতে নিশ্চয়ই কাজের মেয়ে হিসেবে আছ। "
রিয়া নার্ভাস হেসে উঠল। "সেটা তোমাকে বলার দরকার দেখছি না। "
"আসলে," তানিম নিজেকে সোজা করে দাঁড়াল, "আমার কিছু হিসেব ঠিক মিলছে না।"
রিয়ার নিঃশ্বাস থমকে গেল, "মানে?"
"জায়ান একটা প্রেম করছে। আমরা যতদূর জানতে পেরেছি এই বাড়ির মালিক মিসেস আখতারের নাতনির সাথে। নাম হল রিয়া। কিন্তু রিয়া নামে এই বাড়ির কোন নাতনি নেই। রিয়া হচ্ছ তুমি। জায়ানের মত প্রতিষ্ঠিত ফ্যামিলির একটা ছেলে কেন কাজের মেয়ের পরিচয় ব্যবহার করবে তা বুঝতে পারছি না?"
আতঙ্ক রিয়ার বুক চিরে বেরিয়ে আসতে চাইছিল।রিয়া স্পষ্ট বুঝতে পারছে এই ছেলে মিথ্যে বলছে। এই ছেলে আসলে সত্যটা জানে। এখন রিয়ার মুখ থেকে বের করার জন্য মিথ্যে কথার ফাঁদ পাতছে। এই ছেলেই কি রিয়াকে মেসেজ দিয়েছিল? "আমি বুঝতে পারছি না তুমি কী বলতে চাইছ," রিয়া দ্রুত বলল।এই ছেলের ফাঁদে পা দিল না। "তুমি হয়তো ভুল করছ।"
"আহা, ভুল করব কেন? " তানিম মুচকি হাসল। "আমি সব জেনে বুঝেই এসেছি। আমি শুধু বুঝতে চাই, মিথ্যেটা কেন?"
রিয়া দ্রুত চিন্তা করছিল। এই ছেলেটা আসলে কতটুকু জানে? কতটা বলা নিরাপদ হবে?
"তোমার এখন চলে যাওয়া উচিত," রিয়া দৃঢ় গলায় বলল। গেট থেকে এক পা পিছিয়ে গেল।
তানিমের মুখের ভাব বদলে গেল, ওর ভেতরের নোংরা চেহারা যেন বের হয়ে এল। "তুমি যতটা চালাক ভাবছো, ততটা নও রিয়া। আমি যা জানি, সেটা যদি জায়ানকে বলে দিই, তাহলে কী হবে?"
রিয়ার হৃদস্পন্দন দ্রুত হয়ে উঠল। "চলে যাও," ও ঝাঁঝালো গলায় বলল, যদিও ওর গলা কিছুটা কাঁপছিল।
"ঠিক আছে," তানিম দু’হাত তুলে আত্মসমর্পণের ভঙ্গি করল। "কিন্তু আমার কথা মনে রেখো। আমার নম্বর তোমার কাছে আছে।"
এই বলে ও ধীর পায়ে হেঁটে চলে গেল। রিয়া গেটের পাশে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
ভেতরে ফিরে এসে দেয়ালের সাথে ভর দিয়ে দাঁড়াল। ওর হাত কাঁপছিল।
রিয়া সবসময় জানত যে একদিন ওর মিথ্যা ধরা পড়বেই। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি হবে, সেটা ভাবেনি। আর এখন, জায়ানের বন্ধু ওকে ফাঁসানোর হুমকি দিচ্ছে।
তানিম আসলে কী চায়? ও কেন এখনো জায়ানকে কিছু বলেনি?
এই প্রশ্নগুলো রিয়ার মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগল।রিয়ার মনে হল এই বাসার দেয়ালগুলো ওর দিকে চেপে আসছে। ওর হাতে সময় কমে আসছে।অনেক কম।
১১।
রিয়ার স্বপ্নের মত দিনগুলো এক মুহূর্তে ভেঙ্গে গেল। তানিম ওর জীবনে সাক্ষাৎ শয়তানের মত দেখা দিল। ওর করা পাপ গুলো যেন জাহান্নামের দরজা খুলে দিল । সেই দরজা দিয়ে তানিম বের হল। রিয়াকে শাস্তি ভোগ করতে হবে। সেইদিন বিকেলে ওর মা ওকে ফোন দিল-
-হ্যাঁরে তানিম নামে কাউকে চিনিস?
-নাহ। রিয়া যেন আকাশ থেকে পড়ল।
-একটু আগে একটা ছেলে আসল। তোর খোঁজ খবর নিচ্ছিল।
-কি খোঁজখবর?
-এমনিতেই। বাসাতে কে কে থাকে, তুই কতদিন ধরে কাজ করছিস, কতদূর পড়াশুনা করছিস এসব। আমি নাম জিজ্ঞেস করলাম। বলল তানিম। আর তেমন কিছু বলল না। কোন কি ঝামেলা হইছে?
-নাহ।
-আমি একটু চাপাচাপি করতে বলল মিসেস আখতারের নাতনি ওকে পাঠিয়েছে। কেন পাঠাইছে জিজ্ঞেস করলাম, বলল তোকে জিজ্ঞেস করতে।
-আচ্ছা। এরপর গেলে তুমি আমাকে ফোন দিও।
-ছেলেটাকে দেখে আমার পছন্দ হয় নাই। সাবধানে থাকিস তুই।
রিয়া ফোন রেখে দিল। ছেলেটা ওর বাসা পর্যন্ত চলে গেছে। জায়ানের কাছে যেতে কতক্ষণ?
একটু পরেই ওর ফোনে মেসেজ আসল,
"আমাদের কথা বলা দরকার। সন্ধ্যা ৭ টায় ৮ নম্বরের কফি শপে দেখা করো। আমাকে যদি তোমার বাসায় আসতে বাধ্য করো, তাহলে কিন্তু ভালো হবে না।"
রিয়ার নিঃশ্বাস ভারী হয়ে এল। ও আর তানিমকে উপেক্ষা করতে পারল না—বিশেষ করে যখন অনেকে কিছু ওর হাতে। জায়ানের সঙ্গে গড়ে তোলা জীবনের সবকিছু ধ্বংস করে দিতে পারে। কিন্তু তানিমের সঙ্গে দেখা করা মানে যেন সরাসরি ফাঁদে পা দেওয়া।
রাত ৭ টা দ্রুতই বেজে গেল। সাধারণ পোশাকে পাল্টে রিয়া বাসা থেকে বেরিয়ে পড়ল। রাস্তাগুলো আগের চেয়ে আরও শীতল লাগছিল। শহরের কোলাহলও ওর বুকের দপদপানিকে চাপা দিতে পারছিল না।
ক্যাফেতে পৌঁছানোর পর দেখল, তানিম আগে থেকেই অপেক্ষা করছিল। ও পেছনের এক টেবিলে বসে ছিল। মুখে এক বিজয়ের হাসি।
"রিয়া," ও বলল। রিয়া এগিয়ে আসতেই উঠে দাঁড়াল। "আমি জানতাম তুমি আসবে।"
রিয়া চুপচাপ বসে পড়ল।
"রিল্যাক্স," তানিম মুচকি হেসে বলল। বসে চেয়ারে হেলান দিল। "আমি ঝামেলা করতে আসিনি। শুধু এটা বুঝতে চাই, তোমার মতো একটা মেয়ে কেন এসব করে বেড়াচ্ছে?"
রিয়া সরাসরি প্রশ্ন করল, "তুমি কী চাও, তানিম?"
তানিম আঙুল টেবিলে ঠুকতে ঠুকতে হাসল। "সোজাসাপ্টা! এটা ভালো লাগল। ঠিক আছে, আসল কথায় আসি। আমি এখনো জায়ানকে কিছু বলিনি। কিন্তু আমি চুপ থাকার একটা বিনিময় চাই।"
রিয়ার শরীরে শীতল স্রোত বয়ে গেল। "কেমন বিনিময়?"
"ওহ, খুব কঠিন কিছু নয়," তানিম কাঁধ ঝাঁকালো। "তুমি দারুণ ইন্টারেস্টিং, রিয়া। আর আমার মনে হয়, আমরা একে অপরের উপকারে আসতে পারি।"
রিয়া টেবিলের নিচে মুঠো শক্ত করল। ভেতরে রাগ আর ভয় একসঙ্গে দোল খাচ্ছিল। "উপকার মানে কী?"
তানিম সামনের দিকে ঝুঁকে এল। চোখ কুঁচকে বলল, "তুমি আমাকে এন্টারটেইন করবে। আমি তোমার ছোট্ট গোপন বিষয়টা গোপন রাখব। একদম সহজ হিসেব।"
রিয়ার সারা শরীর অবশ হয়ে গেল। ওর কথার ভিতরে লুকিয়ে থাকা ইঙ্গিতগুলো স্পষ্ট ছিল—একটা হুমকি, একটা ফাঁদ।
"আমি তোমার কোনো খেলায় অংশ নেব না," রিয়া কঠিন গলায় বলল। যদিও ওর কথা বলতে ইচ্ছে করছিল না। তানিম হেসে ফেলল। "তোমার ইচ্ছা। তবে যদি আমার শর্ত না মানো, তাহলে আমি গ্যারান্টি দিতে পারছি না। জায়ান তার ‘আখতার রাজকন্যা’ নিয়ে কাল কী ভাববে। আর বিশ্বাস করো, ও কিন্তু তোমার আসল পরিচয় ভালোভাবে নেবে না!"
রিয়ার নিঃশ্বাস কেঁপে উঠল। ও চিৎকার করতে চাইল। উঠে চলে যেতে চাইল, কিন্তু জানত এতে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে।
রিয়া চাপা স্বরে বলল, "তুমি আসলে কী চাও?"
"এই মুহূর্তে? শুধু তোমার সময়," তানিম ঠোঁটে বাঁকা হাসি ফুটিয়ে বলল। ‘আমার সাথে তোমাকে একদিন ঘুরতে যেতে হবে, ঠিক যেমন তুমি জায়ানের সাথে গিয়েছিলে। কেবিনে। এরপর দেখা যাবে, সবকিছু কোথায় গড়ায়।"বলার পর তানিম ওর ফোনটা বের করে দেখাল।একটা ছবি। রিয়া আর জায়ানকে দেখা গেল। ওরা ঘুরে বেড়াচ্ছে।
ক্যাফে থেকে বেরিয়ে আসার সময় রিয়ার মনে হচ্ছিল, ওর ভেতরটা উল্টে গেছে। তানিম এখনো স্পষ্ট করে কিছু দাবি করেনি, কিন্তু ওর ইঙ্গিত যথেষ্ট ছিল। ও জানত, তানিমের ক্ষমতা আছে ওর পুরো জীবন ধ্বংস করার, আর সে সেটা ব্যবহার করতেও দ্বিধা করবে না।
বাড়ির দিকে হাঁটতে হাঁটতে রিয়ার মন এলোমেলো হয়ে গেল। এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পাওয়ার কোনো উপায় আছে কি? ও কি নিজেই জায়ানকে সব বলে দেবে,জায়ান কি ওকে ক্ষমা করবে? নাকি সেটা আরও খারাপ হবে?
এখন আপাতত ও শুধু একটু সময় নষ্ট করতে চাইল- আশা করল যে তানিম এর মনটা একটু নরম হবে।
ভাগ্য ভালো, জায়ান জরুরি কাজের জন্য কয়েক দিনের জন্য শহরের বাইরে গেছে। এই কটা দিন ওর জন্য অমূল্য, একটা উপায় বের করতে হবে ।কিন্তু এটা কি কেবল কাকতালীয়? নাকি তানিম ইচ্ছে করেই এই সময়টা বেছে নিয়েছে, যখন রিয়া একা একা থাকবে ? জায়ান থাকবে দূরে?
চিন্তাটা রিয়ার শরীর যেন শক্তিহীন হয়ে এল । তবে ও নিজেকে দ্রুত সামলে নিল। এত দ্রুত খেই হারালে চলবে না।
১২।
পরদিন সকালে তানিম আবার রিয়াকে ডেকে পাঠাল। রিয়া সেই অন্ধকার ক্যাফের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকল , যেখানে তানিম ওকে ডেকেছিল।রিয়া যেন তানিমের হাতের পুতুল হয়ে গেছে। যা বলতে করা হচ্ছিল তাই করছিল। রাস্তা অস্বাভাবিকভাবে নীরব ছিল। রিয়া মুষ্টি শক্ত করে, সাহস সঞ্চয় করে ভেতরে ঢুকল।
তানিম আগেই এসে বসে ছিল। কোণের টেবিলে। মুখে সেই ভিলেনের হাসি।
ক্যাফের বাতাস ভারী ও দমবন্ধ লাগছিল। রিয়া ওর সামনে বসলো। টেবিলের নিচে নিজের হাত শক্ত করে আঁকড়ে ছিল। তানিমের বিদ্রুপভরা হাসি অসহ্য লাগছিল, যেন ওর উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে।
"বেশি সময় নষ্ট করবো না, রিয়া," তানিম শুরু করল, স্বর ঠান্ডা কিন্তু তাতে সুপ্ত হুমকির আভাস। "তোমাকে একটা রাত সময় দিয়েছি। বল তুমি কি ভাবলে? "
রিয়া চোখে চোখ রাখল, চোয়াল শক্ত করল। "তুমি যা চাচ্ছ তা আমার পক্ষে দেয়া সম্ভব না। ।"
তানিম পিছনে হেলে পড়ল। ভাবলেশহীন ভঙ্গিতে কাঁধ ঝাঁকালো। "অন্য কিছু চাইতাম" বলল সে। "কিন্তু তোমাকে দেখার পর সিদ্ধান্ত বদলেছি’ তানিম ওর শরীরের দিকে স্পষ্ট ইঙ্গিত করল। রিয়ার গা ঘিনঘিন করে উঠল।
"আমি কিছুই দেব না," রিয়া কঠিন হবার চেষ্টা করল। কিন্তু নিজের কাছেই নিজেকে শক্তিহীন মনে হল।
তানিম হেসে সামনের দিকে ঝুঁকে এল। তাদের মুখ প্রায় কাছাকাছি। "ওহ, তুমি দেবে," ও মুচকি হাসল। "দেখো, এখনো আমি দয়া দেখাচ্ছি। জায়ানকে জানাইনি তুমি আসলে কে। তোমার আসল পরিচয় এখনো গোপন রেখেছি।"
রিয়ার চুপ করে থাকল। ।
"ভাবো তো, কেমন লাগবে জায়ানের?" তানিম মজা পেয়ে বলে চলল। "যখন সে জানতে পারবে তুমি সেই অভিজাত, ধনী পরিবারের কেউ নও ? বরং, তুমি একটা বস্তির মেয়ে। বাসা বাড়িতে কাজ করে জীবন চালাও ?"
রিয়ার চোখে জল এসে গেল, কিন্তু সে তা ঝরতে দিল না। তানিমের সামনে দুর্বল হওয়া চলবে না। "কেন করছো এসব?" রিয়া ফিসফিস করল। "তুমি কী পাবে আমার জীবন নষ্ট করে?"
তানিমের হাসি আরও চওড়া হলো। "ওহ, রিয়া, এটা তোমার জীবন নষ্ট করার ব্যাপার না, বিষয়টা খুব একটা কঠিন না তুমি যতটা ভাবছ। আধুনিক যুগের মেয়ে তুমি। ছেলেদের সাথে বিছানায় যাওয়াত আজকাল ফ্যাশন হয়ে গেছে। "
তানিম আবার হেলান দিল, হাত গুটিয়ে নিল। "আমি যা চাই তা দাও, আমি চুপ থাকব।"
রিয়ার বমি বমি ভাব হচ্ছিল। "এতটা নিচে না নামলে কি পারতে না" ও তীব্র গলায় বলল।
"পারতাম হয়ত" তানিম অবহেলায় কাঁধ ঝাঁকালো। "কিন্তু মিথ্যা তো তুমি বলেছো। জায়ানকে ধোঁকা দিয়েছো। নোংরামি পথে তুমিই হাঁটা শুরু করছ। আমি সেই পথে তোমাকে সঙ্গ দিতে চাই। "
রিয়া টেবিল আঁকড়ে ধরলো, মাথার মধ্যে হাজারো চিন্তা ছুটে চললো।
সে কিছুতেই জায়ানকে এভাবে জানতে দিতে পারবে না। কিন্তু তানিমের শর্ত মেনে নেওয়ার চিন্তায় গা শিউরে উঠছিল।
"তুমি অসুস্থ" রিয়া কোনরকমে বলল।
"আর তোমার কোন উপায় নেই," তানিম নিঃসংকোচে জবাব দিল। তারপর উঠে দাঁড়াল, জ্যাকেট গায়ে চাপাল। "ভেবে দেখো, রিয়া। তোমার হাতে অল্প সময় আছে। তারপর..."
সে এক খারাপ ইঙ্গিত করলো, যেন রিয়াকে গুরুত্ব দেওয়ারও প্রয়োজন নেই। "তারপর কী হবে, তুমি জানোই তো।"
রিয়া অনেকক্ষণ ধরে টেবিলে জমে বসে থাকল, মনে যেন ঝড় বয়ে যাচ্ছে। আশেপাশের মানুষজন জানতেই পারল না ওর ভেতরে চলা যুদ্ধের কথা।
আখতার বাড়িতে ফেরার পর ও বিছানায় পড়ে গেল । ওর খুব দমবন্ধ লাগছিল ।
তানিম ওকে কোণঠাসা করে ফেলেছে, আর কোনো পথ খোলা নেই।
রিয়ার ফোন বেজে উঠলো, ওকে বাস্তবে ফিরিয়ে আনলো।
জায়ান: "তোমাকে খুব মিস করছি। আর অপেক্ষা করতে পারছি না তোমাকে দেখার জন্য।"
ওর আঙুলের ফাঁকে ফোনটা শক্ত হয়ে থাকল। চোখের কোণে জল জমলো।
জায়ান তার আলো, তার আশা। কিন্তু তানিমের ছায়া সবকিছু গ্রাস করতে চলেছে।
রিয়া বিছানায় গুটিয়ে বসে রইলো, ফোনটা শক্ত করে ধরে।
তার হাতে বেশি সময় নেই।—ও কতদূর যেতে রাজি ওর ভালোবাসা রক্ষার জন্য।
আর তখনই, এক শীতল ভাবনা তার মনে দানা বাঁধতে শুরু করলো—
এত সহজে হাল ছেড়ে দেয়ার মেয়ে রিয়া নয়।
১৩ ।
রিয়া থমকে বসে ছিল। কম আলোয় ঘোলাটে ক্যাফেতে। ওর মন তনিমের হুমকির ভারে আচ্ছন্ন। তানিম ওকে এমন এক কোণায় ঠেলে দিয়েছে। এখন ওর কথা শুনলেও ধ্বংস ,না শুনলেও ক্ষতি। রিয়াকে শুধু একটা পথ বেছে নিতে হবে। জায়ান যদি সত্যটা জেনে যায়, সেই ভয় তনিমের যে কোনো কথার চেয়েও বেশি কষ্ট দিচ্ছিল।তাই রিয়া তানিমের কথা শুনবে বলে সিদ্ধান্ত নিল।
তনিম সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ল, ওর ভিলেন মার্কা হাসি রিয়াকে আরও ভেঙ্গে দিচ্ছিল। “তুমি বুদ্ধিমানের মতো সিদ্ধান্ত নিয়েছ” তার কণ্ঠস্বর ছিল তাচ্ছিল্যে ভরা।
রিয়া কোনো উত্তর দিল না। ওর নীরবতাই যথেষ্ট জবাব।
রিয়া নার্ভাসভাবে দাঁড়িয়ে ছিল। ওরা একটা হোটেলে প্রবেশ করল।তানিম প্রতিটি পদক্ষেপে জানিয়ে দিচ্ছিল যে সে এখানকার ক্ষমতার মালিক।
“বাহ, দারুণ জায়গা,” ও প্রতিটা জিনিসের প্রশংসা করতে লাগল। “নিজের সবকিছু হারিয়েও জায়ানকে ধরে রাখতে চাইছ। এমন একটা প্রেমিকা পেলে আমি আর কিছু চাইতাম না।” তানিম মজা করতেই লাগল।
রিয়া কিছু বলল না। কি আর বলবে। কিছু বলার মত অবস্থা ওর নেই।ও চাচ্ছিল সবকিছু তাড়াতাড়ি শেষ হোক । প্রতিটি ধাপে ওর মনে হচ্ছিল ওর বোঝার ভার আরও বেড়ে যাচ্ছে। পালানোর পথ খুঁজতে ওর মন পাগলের মতো ভাবছিল। কিন্তু আপাতত সবকিছু মেনে নিতে বাধ্য হল।
ওরা রুমে ঢুকল। জানালার পর্দা টানা ছিল। ঘরটিতে ছিল এক রকম ম্লান। দমচাপা পরিবেশ। তনিম ওর দিকে ফিরে তাকাল। তার হাসি আরও অন্ধকার হয়ে উঠল।
“কি করতে হবে তুমি জানো,” তানিমের কণ্ঠ ছিল নিচু, কিন্তু হুমকির মত ।
রিয়ার হাত কাঁপতে লাগল যখন ও ওর জামার বোতাম খুলল, কাপড়টি কাঁধ বেয়ে মাটিতে পড়ে গেল। তনিমের চোখ ওর ওপর দিয়ে বয়ে গেল, অভিব্যক্তিতে ফুটে উঠল বিজয়ের তৃপ্তি। রিয়ার গলা শুকিয়ে এল। কিন্তু সে নিজেকে স্থির রাখল।
তনিম ধীরে ধীরে রিয়ার দিকে এগিয়ে এল। তার আঙুল রিয়ার ত্বকের ওপর দিয়ে ছুঁতে লাগল। “তুমি আমার দেখা সবচেয়ে সুন্দর মেয়ে ” ও বলল।
রিয়ার নিজের ঠোঁট কামড়ে ধরল।নিজের মনে অন্য কিছু ভাবার চেষ্টা করল।তানিম ওকে আরও কাছে টানল, ওর ঠোঁটের স্পর্শ ছিল কাঠের মত। রিয়া প্রতিক্রিয়া দেখাল যান্ত্রিকভাবে, ওর মন মুহূর্তের বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। রিয়ার মন ছিল শুধুমাত্র একটি জিনিসে—কিভাবে এই দুঃস্বপ্ন থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
সেই রাত ছিল এক বিভীষিকার, কুয়াশাচ্ছন্ন অধ্যায়। যেখানে রিয়ার শরীরের ওপর তনিমের পাপ ওকে আরও ঘৃণিত করে তুলছিল। রিয়া ওর বিদ্বেষ গিলে ফেলল। জানত যে প্রতিরোধ করলে খারাপ লাগা আরও বাড়বে।
যখন সব শেষ হলো। তনিম পিছিয়ে গেল। তার মুখে সেই ভিলেনের হাসি। “দেখলে? এত কঠিন ছিল না,” তানিম বলল ঠোঁটের কোণে হাসি ঝুলিয়ে।
রিয়া নির্বাকভাবে ওর কাপড় গুছিয়ে নিল। জিনিসটা শেষ হয়েছে আপাতত এই চিন্তা টুকু রিয়াকে নড়তে সাহায্য করছিল।
কিন্তু রিয়া জানত না। তনিম আগেই একটি ছোট ক্যামেরা লুকিয়ে রেখেছিল। পুরো ঘটনাটি ধারণ করেছে। রাতে তানিম ভিডিওটি বের করল। ওর ঠোঁটে এক দানবীয় হাসি ফুটে উঠল। তানিম ইতোমধ্যেই তার পরবর্তী ফাঁদ ঠিক করে ফেলেছে।
পরদিন, রিয়া তার মন থেকে আগের রাতের স্মৃতি সরিয়ে ফেলার চেষ্টা করল। সে তার কাজে মন দিল। মিসেস আক্তারের যত্ন নেওয়ার কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখল।
কিন্তু ওর এই ক্ষণস্থায়ী স্বাভাবিকতা ধূলিসাৎ হয়ে গেল যখন ওর ফোন বেজে উঠল।
তনিম: “আজ রাতেও দেখা করো। আগের জায়গায়।”
রিয়ার হাত কাঁপতে লাগল। সে কোনো উত্তর দিল না। আশা করল তানিম ওকে ছেড়ে দেবে। কিন্তু কয়েক মুহূর্ত পরই আরেকটি মেসেজ এল।
তনিম: “না আসলে জায়ানকে এটা দেখাব।”
সঙ্গে যুক্ত ছিল একটি ছোট ভিডিও ক্লিপ। রিয়ার রক্ত হিম হয়ে গেল। ও ভিডিওটি খুলে দেখল। মুহূর্তেই তার পুরো পৃথিবী ভেঙে পড়ল। তানিম পুরোটা রেকর্ড করেছে।
ওর চোখ জলে ভরে উঠল। অপমান আর বিশ্বাসঘাতকতার যন্ত্রণায় রিয়ার শরীর কাঁপতে লাগল। তবে রিয়া থেমে গেল না। নিজের কাজগুলো করে যেতে লাগল। যদিও ওর সবকিছু ঝাপসা হয়ে গেল বারবার।
সব কাজ শেষ করে রিয়া ওর ঘরে ফিরে দরজা বন্ধ করল। বিছানার ধারে বসে ফোনের দিকে তাকিয়ে থাকল। তানিমকে কল করবে কি না তা ভাবছিল। ওর আঙুল স্ক্রিনের ওপর স্থির হয়ে থাকল, তারপর একসময় হতাশার সঙ্গে ফোনটা বিছানায় ছুঁড়ে দিল।
সারাটা দিন রিয়া অসহ্য যন্ত্রণায় ছটফট করতে লাগল। ইচ্ছে করছিল গলা ছেড়ে একটু কাঁদতে। কিন্তু ওর কান্না শোনার জন্য কেউত নেই। কান্না করে কি লাভ?
সন্ধ্যায় জায়ান ফোন করল। তার কণ্ঠে ছিল আগের মতোই উষ্ণতা, যা রিয়াকে একই সঙ্গে স্বস্তি দিত আবার কষ্টও।
“হেই,” বলল সে, তার কণ্ঠ যেন কালো মেঘের আড়াল থেকে আসা সূর্যের আলো। “আমার প্রিয়াটা কেমন আছে?”
“আমি ঠিক আছি,” রিয়া বলল, তার কণ্ঠ একটু মলিন শোনাল।
“তুমি ঠিক নেই মনে হচ্ছে,” চিন্তিত গলায় বলল জায়ান। “কিছু হয়েছে?”
“না, আমি একটু ক্লান্ত। অনেক ব্যস্ত দিন কেটেছে,” বলল রিয়া।
“রিয়া, তুমি জানো, যদি কিছু তোমাকে কষ্ট দেয়, তাহলে আমাকে বলতে পারো,” জায়ান আবেগভরে বলল।
জায়ানের কথা শুনে রিয়ার হৃদয়টা ব্যথায় ভরে উঠল। ও সব বলতে চেয়েছিল, সত্যটা জানাতে চেয়েছিল। কিন্তু তানিমের হুমকির কথা মনে পড়তেই সে চুপ হয়ে গেল।
“আমি ঠিক আছি, সত্যিই,” রিয়া বলল, একটা হাসি ফোটানোর চেষ্টা করল। জায়ান দেখতে পাচ্ছিল না। “শুধু একটু বিশ্রাম দরকার।”
“ঠিক আছে,” বলল জায়ান। যদিও ওর কণ্ঠে সন্দেহ ছিল। “কিন্তু কথা দাও, যদি কিছু হয়, আমাকে জানাবে।”
“কথা দিলাম,” বলল রিয়া, যদিও ওর কণ্ঠ ফাঁপা শোনাল।
সময় গড়িয়ে চলল । রিয়া তার ছোট রুমে বসে রইল। ওর চিন্তাগুলো ভাঙা কাচের টুকরোর মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে রইল। হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠল ওকে বাস্তবে ফিরিয়ে আনল।
এটা তানিমের মেসেজ ছিল:
"আজ রাতে তোমার অপেক্ষায়"
১৪ ।
তুই একটা কুত্তার বাচ্চা, নিজের অজান্তেই মেসেজটা লিখে ফেলল। শেষ পর্যন্ত আর পাঠাল না। ডিলিট করে দিল।ছাদের দিকে চেয়ে শুয়ে রইল। রিয়ার মন তীব্র গতিতে ছুটছিল।ঘণ্টা কেটে যাচ্ছিল, আর তখনই এক অন্ধকার চিন্তা তার মনে জায়গা করে নিল।
যদি তানিম এতদূর যেতে পারে, তাহলে ওকে থামাতে রিয়াকেও আরও অনেকে দূর যেতে হবে ।
কিন্তু রিয়া কি পারবে? রিয়ার দুচোখ দিয়ে জলের ধারা বইতেই লাগল।
রিয়া কি ওর মাকে বিষয়টা খুলে বলবে? মার একজন পরিচিত লোক আছে। একবার রিয়ার কি মনে হল, খুব পড়াশুনা করল। পড়াশুনা করে স্কুলে ফাস্ট হয়ে গেল। সবার মাথা ঘুরে গেল। এতদিন রিয়া স্কুলে গরিব ঘরের দুষ্ট মেয়ে হিসেবে পরিচিত ছিল। হঠাৎ ভাল রেজাল্ট করায় অন্যরা মেনে নিতে পারল না। রিয়ার নামে আজেবাজে কথা ছড়াতে লাগল। রিয়ার বাবা যে কয়েকবার জেল খেটেছে সেটা সবার মুখে মুখে ঘুরতে লাগল। রিয়া হয়ে গেল চোরের মেয়ে।এমনকি বলাবলি করতে লাগল, চোরের মেয়ে এই স্কুলে থাকলে কেউ পড়বে না। স্কুলের হেড বাধ্য হয়ে রিয়াকে টি সি দিবেন বলে সিদ্ধান্ত নিলেন। রিয়া স্কুলে যাওয়া ছেড়ে দিল। পড়াশুনার প্রতি ওর ঘৃণা চলে এল। সেবার ওর মা ওকে নিয়ে সেই লোকের সাথে দেখা করেছিল। কাল, মোটা। মাস্ক পরেছিল বলে চেহারা দেখে নি। তবে তিনি অনেক ক্ষমতাবান মনে হল। পরেরদিন রিয়ার স্কুলের হেড ওর বাসায় এসে বসেছিল। বার বার মাফ চাচ্ছিল। রিয়ার আর কোন সমস্যা হবে না বলে রিয়াকে আবার স্কুলে যেতে বলেছিল। কিন্তু রিয়া আর স্কুলে যায় নি। রিয়ার খুব ভাল লেগেছিল। হেডস্যারের মত লোক ওর বাসায় এসে মাফ চাচ্ছে বিষয়টা ওকে যথেষ্ট নাড়া দিয়েছিল। নিজেকে ছোটলোকের বাজে মেয়ে ভাবা বাদ দিয়েছিল।রিয়ার বাপ মাতাল হলেও মা একেবারে ফেলনা না। মায়ের জন্যই ও সেবার নতুন করে বাঁচতে শিখেছিল। মাকে নিয়ে সেই লোকটার কাছে কি যাওয়া যায়? না মনে হয়। মাকে বিষয়টা কেমনে বলবে? একদিকে রিয়া মিথ্যে কথা বলে প্রেম করছে। অন্যদিকে আরেক ছেলের সাথে ওর বাজে ভিডিও। ওনারা কি ভাববে? খারাপ ভিডিওর কথা ও কাউকে বলতে চাচ্ছিল না।এক কান, দুই কান হয়েই পরে বিষয়টা ছড়িয়ে যেতে পারে।নাহ। যা করার রিয়াকেই করতেই হবে। ওর হৃদস্পন্দন দ্রুত হয়ে উঠল। আতঙ্ক আর ঘৃণা ওকে চেপে ধরছিল। রিয়া মন স্থির করে ফেলল। ও আর এই তানিমকে ছেড়ে দিবে না।এবার রিয়ার পালা।
রিয়া ফোন হাতে তুলে নিল।ওর আঙুল কাঁপছিল। রিয়া টাইপ করল:
"আজকে রাতে বের হতে পারব না। আজ রাতে না হয় তুমি আমার কাছে আস ।"
মেসেজ দিয়ে রিয়া কাঁপা মনে অপেক্ষা করল। তানিম কি আসবে? কোন কিছু সন্দেহ করবে নাত। সবকিছুত তানিমের প্লান অনুযায়ী চলছে। ওর নিজের উপর বিশ্বাস খুব বেশি এখন। রিয়াকে সন্দেহ করার কথা না।
সেন্ড করার পর ফোনটা নামিয়ে রাখল। রিয়ার চোখে কঠোর মূর্তি। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা নিজের প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে ও জানল—আজ রাতেই সবকিছুর সমাপ্তি ঘটবে, যেভাবেই হোক।
তানিম মেসেজ দিল,“ওকে। ”
রিয়া সাথে সাথে মিসেস আখতারের সাজের রুমে গেল। আজকে ও একটা লাল শাড়ি বেছে নিল।শাড়ি পরে খুব যত্ন করে সাজল। সাজার পরে আয়নায় নিজেকে দেখে নিজেই মুগ্ধ হল।
“ হ্যালো রিয়া। তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে। ” নিজেই নিজেকে বলল।
তারপর একটু হাসল।
এমন হাসি আগে কখনো হাসে নি রিয়া।
১৫।
রিয়ার মনে একটু দ্বিধা হল। ও কি ঠিক করছে? যদি কোথাও ভুল হয়? যদি তানিম বুঝে ফেলে? তাহলে হয়ত আজকে রাতই রিয়ার জীবনের শেষ রাত হতে পারে। কিন্তু রিয়া জানত, এখন আর পিছিয়ে আসার উপায় নেই। তানিম একটু পরেই এল। রিয়ার সাজ দেখে ওকে কিছুটা বিভ্রান্ত মনে হল। পর মুহূর্তে নিজেকে সামলে নিল।
“ওহ, রিয়া” তানিম বলল, দরজা দিয়ে ঢুকেই। “এজন্যই তোমাকে আমার এত পছন্দ। তুমি জান কিভাবে জীবনটা উপভোগ করতে হয়।”
রিয়া কৃত্রিম হাসি দিল। “তোমার পছন্দ হয়েছে?”
রিয়া ওকে ওর সাজান রুমে নিতে নিতে বলল। তানিম ওর দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমাকে পুরো ফুটন্ত গোলাপের মত লাগছে।”
“চল, তাড়াতাড়ি করি,” রিয়া বলল। যেন আর সময় নষ্ট করতে চায় না।
তানিম রিয়াকে কাছে টেনে নিল। ওর হাত ছিল নোংরা, অধৈর্য।
রিয়া ভেতরে ভেতরে ঘৃণায় জ্বলছিল, কিন্তু নিজেকে শান্ত রাখল। পুরো সময়টা ওর মনে একটাই চিন্তা —বালিশের নিচে লুকিয়ে রাখা ছোট্ট ঘুমের ইনজেকশন, যা ও মিসেস আখতার-এর ওষুধের ক্যাবিনেট থেকে নিয়েছিল।
ঠিক সময়ে বালিশের নিচ থেকে ছোট্ট সিরিঞ্জটা বের করল। নিখুঁত নিশানায় তানিমের কাঁধে ইনজেকশন দিল।
তানিম চমকে উঠল। সামান্য পিছু হটল। বিভ্রান্ত চোখে তাকাল।
“এটা কী ছিল?” ও অস্পষ্ট কণ্ঠে বলল। তানিমের শরীর নিস্তেজ হয়ে পড়তে লাগল।
রিয়া দাঁড়িয়ে রইল। ঠাণ্ডা চোখে তাকিয়ে বলল, “এটা শেষ, তানিম।”
তানিমের দেহ দ্রুত দুর্বল হয়ে পড়ল। চোখের পাতা ভারী হয়ে এল। কয়েক মুহূর্ত পর ও নিস্তেজ হয়ে গেল।
রিয়া দাঁড়িয়ে রইল। ওর নিঃশ্বাস দ্রুত চলছিল।রিয়া শুধু অজ্ঞান করার জন্যই ওষুধ ব্যবহার করতে চেয়েছিল। কিন্তু তার মনে থাকা ক্ষোভের কারণে ডোজটা একটু বেশি দিয়ে ফেলেছিল।
“দেখছিস? ? তুই নিজেই নিজের শেষ ডেকে আনলি।” ফিসফিস করে বলল রিয়া।
তানিমের নিঃশ্বাস ধীর হয়ে এল, তারপর থেমে গেল।
রিয়া দ্রুত কাজ করল। বালিশে মুখ চেপে তানিমের মৃত্যু নিশ্চিত করল। আতঙ্কিত হওয়ার সময় ওর ছিল না।তানিমের দেহকে টেনে নিয়ে গেল। স্টোররুমে একটা ফ্রিজার ছিল। সমস্ত শক্তি দিয়ে রিয়া তানিমকে সেটার ভেতরে ফেলল। তারপর দরজাটা বন্ধ করল।
ফিরে এসে ও নিজের হাত ভাল করে করে পরিষ্কার করল। কিন্তু তবু যেন তানিমের গায়ের গন্ধ লেগে ছিল।
“শেষ”
অন্তত সেই রাতের জন্য রিয়ার তাই মনে হয়েছিল।
১৬।
স্টোর রুমটা আগের চেয়েও ঠান্ডা লাগছিল, ফ্রিজারের গভীর গুঞ্জন রিয়ার কানে বাজছিল। প্রতি বার রুমের পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় ওর কেমন যেন লাগছিল। তিন দিন হয়ে গেছে, রিয়া তানিমের দেহ সেখানে লুকিয়ে রেখেছে, কিন্তু সেই রাতের স্মৃতি ওর মনে ছায়ার মতো সঙ্গী হয়ে ছিল।
বাড়ির প্রতিটি দরজা-জানালার শব্দ যেন ওর কানে আঘাত করছিল। ওর হৃদস্পন্দন দ্রুত করে তুলছিল। রিয়া খুব সাবধান ছিল—ফ্রিজারের তালা বন্ধ রাখা, স্টোর রুমের দরজা বারবার পরীক্ষা করা। কেউ সচরাচর ওখানে যেত না। কিন্তু রিয়া মনে শান্তি পাচ্ছিল না। সবসময় সতর্ক থাকতে চেষ্টা করল।
এক বিকেলে রিয়া চা খাচ্ছিল।হঠাৎ কলিং বেল বেজে উঠল। শব্দটা শুনে ও এতটাই চমকে গেল যে হাতে ধরা কাপটা প্রায় ফেলে দিচ্ছিল।
গ্লাসটা টেবিলে নামিয়ে রিয়া দরজার দিকে এগিয়ে গেল। দরজা খোলার পর ওর শরীরের রক্ত হিম হয়ে গেল।
একজন পুলিশ অফিসার দাঁড়িয়ে ছিল, তার ইউনিফর্ম ঝকঝকে, মুখে কৌতহল।
“আমি অফিসার জামান। আমি কি ভিতরে আসতে পারি?” তিনি বললেন, সামান্য মাথা ঝুঁকিয়ে।
রিয়ার হাত ঘামে ভিজে উঠল, কিন্তু ও একটা সৌজন্যমূলক হাসি হাসল। “অবশ্যই,” রিয়া বলল, সরে দাঁড়িয়ে।
অফিসার ঘরে ঢুকে বাড়ির বিলাসবহুল ইন্টেরিয়র দেখলেন, তারপর বললেন, “দুঃখিত আপনাকে বিরক্ত করার জন্য, কিন্তু আমি একজন নিখোঁজ ব্যক্তির ব্যাপারে তদন্ত করছি। তানিম শেখ নামে এক যুবক কয়েক দিন আগে এই এলাকায় শেষবারের মতো দেখা গিয়েছিল। কেউ তাকে দেখেছে কিনা, তা জানতে জিজ্ঞাসাবাদ করছি।”
রিয়ার গলা শুকিয়ে গেল, “তানিম শেখ?” রিয়া যেন বিস্মিত হলো, “আমি দুঃখিত, আমি এমন কাউকে চিনি না।”
অফিসার জামান মাথা নাড়লেন, পকেট থেকে একটা ছোট নোটবুক বের করলেন। “সে মাঝারি উচ্চতার, গাঢ় চুল। সম্প্রতি এই এলাকায় তাকে ঘোরাফেরা করতে দেখা গেছে বলে জানা গেছে। আপনি নিশ্চিত, আপনি তাকে দেখেননি?”
রিয়া মাথা নাড়ল, তার কণ্ঠস্বর স্থির রাখল। “না, আমি দেখিনি। এই বাড়িটা বেশ নির্জন জায়গায়, আমি খুব একটা বের হই না, শুধু প্রয়োজনীয় কাজ ছাড়া।”
অফিসার তার দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকালেন, যেন তিনি রিয়ার মনের গভীর পর্যন্ত দেখে নিতে পারেন। “এরকম কিছু কি শুনেছেন? একটা ছেলেকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না বা কাছাকাছি কিছু? ”
“না,” রিয়া দ্রুত জবাব দিল। “মিসেস আখতার এমন অবস্থায় নেই যে কিছু খেয়াল করতে পারেন, আর কর্মচারীর সংখ্যাও এখানে তেমন নেই”
আপনার নাম? পরিচয়? কতদিন এখানে কাজ করছেন? আর কে কে কাজ করে?
জামান সবকিছু নোট লিখলেন, তারপর বললেন, “আমি বুঝতে পারছি। তানিম একটু খারাপ স্বভাবের ছেলে ছিল। বড়লোকদের আশে পাশে ঘোরাঘুরি করত, তারপর তাদের কোন গোপন তথ্য হাতিয়ে নিয়ে তাদের ব্লাকমেইল করার চেষ্টা করত। আপনাদের সাবধান করে দিতেই এখানে আসা। হারামজাদা নতুন কি মতলব করছে কি জানে?”
রিয়া মাথা নাড়ল। ওর কানে রক্ত চড়ছিল। “আমি বুঝলাম। যদি কিছু জানতে পারি, তাহলে আপনাকে জানাব।”
অফিসার হালকা হাসলেন। “এটাই বলতে চাচ্ছিলাম। আপনাকে ধন্যবাদ।”
রিয়া তাকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিল। মনে হচ্ছিল ওর পা পাথরের মতো ভারী হয়ে গেছে। দরজার ঠিক বাইরে দাঁড়িয়ে জামান আবার পেছন ফিরে বললেন, “ওহ, আরেকটা কথা। তানিমের লাস্ট ফোন লোকেশন এই বাড়িটায় দেখাচ্ছিল।তাই আমি নিজে এসে দেখে গেলাম। আপানারা একটু সাবধানে থাকবেন। আর কিছু জানতে পারলে আমাকে জানাবেন।”
রিয়ার হৃদয় এক মুহূর্ত থেমে গেল, কিন্তু ও মাথা নাড়ল। “আমি অন্যদের জিজ্ঞাসা করে দেখব। কেউ কিছু জানতে পারে নাকি।”
“অনুগ্রহ করে করবেন,” জামান বললেন। “আর যদি কিছু জানতে পারেন, তবে এখানে আমার কার্ড আছে।” তিনি একটি ছোট ভিজিটিং কার্ড এগিয়ে দিলেন। তারপর মাথা ঝুঁকিয়ে বিদায় জানিয়ে চলে গেলেন।
দরজা বন্ধ হতেই রিয়া তার ওপর হেলে পড়ল। হাঁটু যেন দুর্বল হয়ে পড়েছে। তানিমের ফোন , মানিব্যাগ ও আগেই একটা ব্যাগে করে লেকে ফেলে দিয়ে এসেছে। ভাগ্যিস দিয়েছিল। নাহলে ধরা পড়ে যেতে পারত। ও নিজেকে সামলে নিল। দরজা থেকে সরে গেল যাতে কেউ ওর দুর্বলতা বুঝতে না পারে।
অফিসার রিয়াকে সন্দেহ করেননি। কিন্তু তিনি যে এই বাড়িতে এসেছেন, সেটাই ওকে আতঙ্কিত করে তুলল। রিয়া এক মুহূর্তের জন্যও অসতর্ক হতে পারবে না।
রিয়ার ভেতরের ভয় ক্রমশ বাড়ছিল।ও ঠিকমতো ঘুমোতে পারছিল না, সামান্য শব্দেই চমকে জেগে উঠছিল।
অফিসার চলে গেলেও রিয়া জানত, ও এখনো নিরাপদ নয়। তানিম হয়তো নিশ্চুপ হয়ে গেছে, কিন্তু ওর অস্তিত্ব এখনো এই আখতার বাড়ির ছায়ায় বাস করছে। সময় যাচ্ছিল। রিয়া বুঝতে পারছিল। রিয়ার এই গোপনীয়তাই হয়তো রিয়ার আসল অপরাধের চেয়েও ভয়ংকর হয়ে উঠবে।
সেই রাতে রিয়া জানালার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। বাইরে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে। বাড়ির চারপাশ ছিল নিস্তব্ধ, কিন্তু ওর মন ছিল অশান্ত। পিছন থেকে জায়ান ওর নাম ধরে ডাকল, রিয়া চমকে উঠল, তারপর দ্রুত নিজেকে স্বাভাবিক করে ফেলল।গত দুইদিন জায়ান আখতার বাড়িতে রিয়ার সাথে রাত কাটাচ্ছে। রিয়া চাচ্ছিল জায়ান ওর আশেপাশে থাকুক। একা একা তানিমের লাশ পাশে নিয়ে ওর ঘুমুতে ইচ্ছে করছিল না।
“রিয়া, এদিকে আসো,” জায়ান বলল। ওর কণ্ঠে আবেগের ছোঁয়া।জায়ান বিছানার কিনারে বসে ছিল, ওর হাত দুটো বাড়িয়ে ছিল রিয়ার দিকে।
রিয়া ধীর পায়ে জায়ানের দিকে এগিয়ে গেল, আর জায়ান তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। “কী হয়েছে? এত চিন্তিত কেন?” জায়ান ফিসফিস করে বলল, ওর ঠোঁট রিয়ার কপালে ছুঁয়ে গেল। রিয়া কোনো উত্তর দিল না, শুধু ওর মুখ দু’হাতে ধরে গভীর চুম্বনে ডুবে গেল।ওরা একে অপরকে আঁকড়ে ধরল, নিজেদের হারিয়ে ফেলল এক অবশ্যম্ভাবী তীব্রতায়।
যখন সব শেষ হলো, জায়ান ওকে বুকে চেপে ধরে নরমভাবে পিঠে হাত বোলাচ্ছিল। রিয়া শান্তিতে চোখ বন্ধ করল, নিজেকে প্রবোধ দিল যে এই মুহূর্তগুলোর জন্যই ও বেঁচে আছে।
১৭ ।
পরের কয়টা দিন টানটান উত্তেজনায় কাটল। এরপর সবকিছু ঠাণ্ডা হয়ে এল। মানুষ মারাটা রিয়ার কাছে ডাল ভাতের মত লাগছিল। বাপকে হত্যা ছিল একটা আবেগি সিদ্ধান্ত। সস্তা মদ খেয়ে এই দেশে অনেক মানুষ মারা যায়। কেউ সেটা খুন বলে সন্দেহ করে নি। কিন্তু তানিমের ক্ষেত্রে রিয়ার কিছু করার ছিল না। ওটা ছিল নর্দমার পোকার মত। তানিমকে মেরে ওর মনে কোন আফসোস নেই। তবে পুলিশ বাসা পর্যন্ত চলে আসায় ওর সত্যিকারের ভয় লেগেছিল। সেই ভয় কাটতে ওর সময় লাগল না। সবকিছু আগেরমতই চলছিল। কেউ রিয়াকে সন্দেহ করল না। রিয়ার সাহস বেড়ে গেল। ওর দ্বারা কিছুই অসম্ভব না। কেমন একটা অনুভূতি কাজ ওর করছিল। জায়ানকে পুরোপুরি নিজের করে পাবার জন্য ও মাতাল হয়ে উঠল। ওর বিশ্বাস অনেক বেড়ে গেল। জায়ানের সাথে ও আরও প্রকাশ্যে, আরও ঘনিষ্ঠভাবে মেলামেশা করা শুরু করল। যেন আর কিছুকে ভয় পাবার নেই। এমনি দিন গুলোতে রিয়ার দরজায় আবার ঘণ্টা বেজে উঠল।দরজা খুলে দেখল এক অপরিচিত মহিলা দাঁড়িয়ে আছেন।
মহিলা লম্বা, সম্ভ্রান্ত পোশাক পরা, চেহারা গম্ভীর। তার চেহারায় কিছু একটা ছিল। রিয়ার কাছে খুব পরিচিত মনে হলেও ও ঠিক মনে করতে পারল না।
"আমি মিসেস আকতারের সঙ্গে দেখা করতে এসেছি," মহিলা সংক্ষিপ্ত স্বরে বললেন।
রিয়া একটু দ্বিধান্বিত হলো। মিসেস আখতারের সাথে এভাবে কেউ দেখা করতে আসে না। "দুঃখিত, মিসেস আকতার এখন বিশ্রামে আছেন। আপনি পরে আসুন ।"
মহিলার মুখের ভাব একটুও বদলাল না। "এটা জরুরি। আমি অপেক্ষা করব।"
রিয়ার মনে অস্বস্তি জেগে উঠল। কেউ যদি বাড়ির ভেতরে ঢুকে নাক গলাতে শুরু করে, তাহলে ওর জন্য তা বড় বিপদ হয়ে দাঁড়াবে। "আমি উনার সঙ্গে কথা বলতে আসছি," বলে মহিলা ভেতরে ঢুকে গেল।
"আমি দুঃখিত, কিন্তু আজ দেখা করা সম্ভব নয়," দৃঢ় স্বরে বলল রিয়া।
মহিলা তার চোখ সরু করে রিয়ার দিকে তাকাল, তারপর এক মৃদু হাসি দিল। "ঠিক আছে। তাহলে আমি তোমার সঙ্গেই কিছুক্ষণ কথা বলব।"
"আমি আসলে খুব ব্যস্ত," বলল রিয়া, গলার স্বর যতটা সম্ভব স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে।
মহিলা হাসি একটুও বদলাল না। "তবুও কিছুক্ষণ সময় বের করাই যায়, তাই না?"
রিয়া অনিচ্ছাসত্ত্বেও মহিলাকে বসতে বলল। নিজে মুখোমুখি বসল। প্রশ্ন শুরু হলো, প্রথমে নিতান্ত সাধারণ।
"তুমি কতদিন ধরে এখানে কাজ করছ?"
"বেশিদিন হয়নি," সাবধানে উত্তর দিল রিয়া।
"তোমার পরিবার কোথায়?"
"এখানে নয়," সংক্ষেপে বলল ও।
মহিলা মাথা কাত করল। "আমি যদি ভুল না করে থাকি তাহলে তোমার নাম রিয়া? "
রিয়া আরও সাবধান হল। "হ্যাঁ "
মহিলা ঠোঁটের কোণে এক রহস্যময় হাসি ফুটিয়ে তুলল। "বিয়ে শাদি হয়ে গেছে? "
রিয়া সামান্য শক্ত হয়ে বসল। "আমি এসব নিয়ে কথা বলতে চাচ্ছি না। "
"কাজের মেয়েদেরত অনেক কম বয়সে বিয়ে হয় । তাই বললাম "
"যা বলতে চাচ্ছেন সরাসরি বলুন। " রিয়া বিরক্ত হয়ে বলল।
মহিলা চেয়ারে হেলান দিলেন। চোখ মেলে গভীরভাবে রিয়াকে পর্যবেক্ষণ করলেন। "তুমি বেশ ঠাণ্ডা মাথার। এত কম বয়সে সবাই এগুলো পারে না।"
রিয়া এক মুহূর্ত ভাবল, এরপর বলল, "আপনি আপনার নাম ঠিকানা রেখে যান। মিসেস আখতার উঠলে আপনার কথা বলব।"
মহিলাটি ধীরে মাথা ঝাঁকালেন। "আমি বের হতে আসি নি। বের করতে এসেছি "
“বুঝলাম না” রিয়া অবাক হল।
মহিলাটির চোখ এবার আরো সরু হলো। "এত কিছু বুঝিস আর এটা বুজছিস না ? "
রিয়ার বুক ধক করে উঠে দাঁড়াল , "আপনি বের না হলে আমি পুলিশ ডাকব। "
মহিলাটি আরও গলা উঁচু করলেন। "ডাক পুলিশ । দেখি কত তোর ক্ষমতা "
রিয়া বুঝতে পারল না ও এখন কি করবে। মহিলার উদ্দেশ্য ঠিক মত ধরতে পারল না। মহিলাকে চেনা চেনা লাগছে। খুব বেশি খারাপ ব্যবহারও করতে পারছে না।
মহিলাটি এবার খোলশ ছেড়ে বের হলেন।সামান্য ঝুঁকে বললেন , "তোর পুলিশ কি জানে তুই আমার ছেলের সাথে মিথ্যা পরিচয় দিয়ে নষ্টামি করছিস ? "
রিয়া জমে গেল। ওর রক্ত হিম হয়ে গেল।এবার রিয়া ধরতে পারল। এই মহিলা জায়ানের মা। চেহারায় মিল আছে।
রিয়া চুপ করে থাকল। কিছু বলার নেই ওর।
জায়ানের মা কড়া গলায় বললেন, "তোর কাছে ঠিক ৩০ মিনিট আছে শহর ছাড়ার জন্য। নাহলে আমি তোর চোদ্দ গুষ্টি সহ ধ্বংস করে দেব।"
জায়ান ওর মা সম্পর্কে কয়েকবার বলেছিল। নিজের প্রেমের বিয়ে টেকে নি। উনি প্রেম জিনিসটাকে ঘৃণা করেন। ওনার এই স্বভাবের কারণে জায়ান এর আগে কোন মেয়ে বন্ধু বা প্রেমিকা টিকিয়ে রাখতে পারেন নি। এতদিন রিয়ার কথাও গোপন রেখেছিল। হয়ত কিছুদিন ওদের মেলামেশা বেড়ে যাওয়ায় উনি টের পেয়ে গেছেন। আর রিয়াকেত মেনে নেয়ার প্রশ্নই আসে না। তাই ওনার এই অগ্নিমূর্তি।
‘আপনি একটু শান্ত হন। আপানাকে এক গ্লাস শরবত বানিয়ে দেই?’ রিয়া মোটেও উত্তেজিত হল না। আরও আশ্চর্য ওর একটুও ভয় করছিল না।
‘তোর হাতের শরবত খাওয়ার চেয়ে বিষ খাওয়া ভাল। ভদ্রভাবে বলছি তোর কথা কানে যায় না? নাকি তোকে মারতে মারতে এই বাড়ি থেকে বের করব?’ জায়ানের মার কথা গুলো আখতার বাড়িতে প্রতিধ্বনি হতে লাগল।
রিয়া মাথা নাড়ল, ভান করল যেন রাজি হয়েছে। "আমি আমার জিনিসপত্র গোছাচ্ছি," বলে সেখান থেকে চলে এল।
নিজের ঘরে ফিরল , রিয়া দ্রুত ভাবতে লাগল। কিছু একটা করতে হবে, নাহলে সব শেষ হয়ে যাবে।জায়ানের মা বিষের কথা বলায় ওর ঘুমের ওষুধের কথা মনে হল।
রিয়া ঘুমের ওষুধের সিরিঞ্জ খুঁজে নিল।
‘তোর হাতে ব্যাগ কোথায়?’ রিয়ার হাতে ব্যাগ না দেখে জায়ানের মা খেঁকিয়ে উঠলেন।
"আমরা একটু কথা বলতে পারি?" রিয়া বলল।
কিন্তু জায়ানের মার কণ্ঠে আগুণ "একটাও কথা না ! তোর মত মাগির সাথে কথা বলার ..."
রিয়া ওনার দিকে এগিয়ে গেল। তারপর মুহূর্তের মধ্যে, সূচটা গেঁথে দিল তার ঘাড়ে। জায়ানের মাকে কথা শেষ করতে দিল না।
জায়ানের মা বিস্ময়ে চোখ বড় করলেন, এরপর ধপ করে পড়ে গেলেন।
রিয়া ঠাণ্ডা কণ্ঠে ফিসফিস করল, "আমি দুঃখিত শাশুড়ি মা। জায়ানকে ছেড়ে আমি কোথাও যাব না।" বলে নিথর দেহটার দিকে তাকিয়ে রইল। একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। ওর হাত কাঁপছিল, ইচ্ছে করছিল চুপ করে বসে থাকতে। কিন্তু রিয়া বসে থাকতে পারছিল না। ও যা শুরু করেছিল তা শেষ করতেই হবে। কাছের ডাইনিং টেবিল থেকে একটি টেবিলক্লথ নিয়ে এল।তার শরীর শক্ত করে জড়িয়ে নিল। কোনও চিহ্ন বা দাগ পড়তে দেয়া যাবে না। অনেক চেষ্টা করে, ও দেহটিকে স্টোরেজ রুমে টেনে নামিয়ে দিল, রিয়ার শরীর চাপের কারণে যেন চিৎকার করছিল। ফ্রিজার যেন ওর দিকে তাকিয়ে ছিল। ফ্রিজারের ঠান্ডা, ধাতব পৃষ্ঠ ওকে উপহাস করছিল। রিয়া ঢাকনা খুলে ভেতরে তানিমের নিথর দেহটি দেখতে পেল। "আমি দুঃখিত," রিয়া ফিসফিসিয়ে বলল, যদিও সে নিশ্চিত ছিল না যে কথাগুলি জায়ানের মা, জায়ানের জন্য নাকি নিজের জন্য বলল। একটু জায়গা করে রিয়া জায়ানের মাকেও ভেতরে ঢুকিয়ে দিল।
রিয়া নিজের রুমে ফিরে এল। হাত ধুতে ধুতে রিয়া ভাবল ও মস্ত একটা ভুল করে ফেলেছে। রিয়াত জানে না জায়ান ইতিমধ্যে ওর বিষয়ে জেনে গেছে কিনা। ওর মা যদি এরমধ্যে জায়ানকে সব বলে দিয়ে থাকে? রিয়ার শরীর কেঁপে উঠল।এমনত হতে পারে জায়ানকে জানিয়েই তিনি এই বাসায় এসছিলেন। পুলিশ যখন জায়ানের মাকে খোঁজা শুরু করবে তখন যদি জায়ান সব বলে দেয়? পুলিশ এসে এই বাসা খুঁজলেই দুটো লাশ বের করে ফেলবে। রিয়াকে দ্রুত জানতে হবে জায়ান ইতিমধ্যে ওর পরিচয় জেনে গেছে কি না। রিয়া কাঁপা হাতে জায়ানকে ফোন দিল।
জায়ানের কণ্ঠ ছিল সবসময়ের মত মায়াভরা।কথাবার্তা স্বাভাবিক। মায়ের বিষয়ে একটি কথাও বলল না । তার মানে জায়ান জানে না । জায়ানের মা কোনভাবে রিয়ার কথা জানতে পেরে নিজে নিজেই এখানে চলে এসেছিলেন। রিয়ার যেন ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল। অন্তত আরও কিছুদিন রিয়া জায়ানকে পুরোপুরি করে পাবার সুযোগ পেল।
কিন্তু এভাবে আর কতদিন?
১৮ ।
জায়ানের মা শাহানা নিখোঁজ হওয়া শহরজুড়ে আলোচিত হল। তিনি ছিলেন একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। নারীদের অধিকার আন্দোলনে মিডিয়ায় পরিচিত মুখ। তার নিখোঁজ হবার বিষয় মিডিয়ায় ঝড় তুলল। রিয়ার জন্য নতুন অভিজ্ঞতা। ওর আগের দুটো খুন ছিল নিচু তলার মানুষ। তারা মরে যাক কিংবা বেঁচে থাকুক। সমাজ খুব একটা মাথা ঘামায় না। বিষয়টা অনেকটা বাসা বাড়ি থেকে ময়লা পরিষ্কার করার মত। কিন্তু জায়ানের মা ছিলেন উপরতলার মানুষ। সবাই নড়েচড়ে বসল। রিয়া নিজের ভিতর অদ্ভুত অনুভূতি লক্ষ্য করল।সবাই জায়ানের মার নিখোঁজ হবার বিষয় নিয়ে কথা বলছিল। কেউ আসল ঘটনা ধরতে পারছিল না। এটা রিয়াকে এক ধরণের চাপা আনন্দ দিতে লাগল। মানুষ খুন কারার যে অপরাধ বোধ আর ও খুঁজে পেল না। রিয়া কি তাহলে দিনে দিনে ঠাণ্ডা মাথার খুনিতে পরিণত হল? এত কঠিন করে রিয়া ভাবতে চাইল না। ও নিজেকে আরও সতর্ক করে নিল। কোন ভাবেই ওর গোপন সত্য গুলো প্রকাশ হতে দেওয়া যাবে না। রিয়া সব খবরের উপর দৃষ্টি রাখল। কেউ বলছিল তিনি কর্পোরেট শত্রুদের হাতে নিখোঁজ, আবার কেউ সন্দেহ করছিল তার ডিভোর্সি জীবন। হয়ত কোন অবৈধ সম্পর্কের বলি। টিভি খুললেই শুধু জায়ানের মার মৃত্যু রহস্যের খবর।
জায়ান ভেঙে পড়ছিল। একসময়ের হাসিখুশি মানুষটি দুশ্চিন্তায় তছনছ হয়ে যাচ্ছিল। ক্লান্তির ছাপ পড়েছিল ওর চোখেমুখে। ও বারবার ফোন করছিল পুলিশ আর পরিচিতজনদের। যদি কোন খোঁজ পাওয়ার যায়।
“আমার মা এমনি এমনি উধাও হয়ে যাওয়ার মত মানুষ না” এক সন্ধ্যায় জায়ান ক্লান্ত হয়ে রিয়ার পাশে সোফায় বসে বলছিল।ওর গলায় যেন কোন জোর ছিল না।রিয়া ওর কাঁধে আলতো করে হাত রাখল, মনের গোপন অপরাধবোধ চেপে রেখে। “তোমাকে বিশ্বাস রাখতে হবে যে তিনি ফিরে আসবেন,” নরম কণ্ঠে বলল রিয়া। “পুলিশ তাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে।”
জায়ান ওর দিকে তাকাল। গভীর কালো চোখে বেদনার ছায়া। “আমার কি করা উচিত বুঝতে পারছি না। সব জায়গায় এত বিভ্রান্তি। আমার মনে হচ্ছে কেউ ওনাকে ঠিক মত খুঁজছে না। সবাই যেন চটকদার কোন নিউজ বানাতে পারলে খুশি। মাকে খুঁজে পাবার বিষয়ে কারো কোন আগ্রহ নেই। ”
রিয়া তার মুখ দু'হাতে ধরে বলল, “এমন করে ভেব না। পৃথিবীটা এমন এ। দেখবে একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে।”
রিয়ার কথা যেন জায়ানের ভেতরের কিছু ভেঙে দিল। ও সামনে ঝুঁকল। ওদের কপাল একসাথে ছুঁয়ে গেল। ওরা গভীরভাবে নিঃশ্বাস ফেলল।
সেই রাতে ওরা একজন আরেকজনের খুব কাছাকাছি থাকল। একজন মা হারানোর কঠিন বাস্তবতা থেকে একটু মুক্তি চাইল, আরেকজন পৃথিবীটাকে নিজের মত করে গড়ে তোলার আশ্বাস চাইল। রিয়ার ভালোবাসা সেই মুহূর্তে জায়ানের খুব দরকার ছিল। রিয়া জায়ানকে খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরছিল, যেন ভয় পাচ্ছিল ও হারিয়ে যাবে।
“রিয়া,” জায়ান ফিসফিস করল। ওর ঘন নিশ্বাস রিয়ার বুকে লাগছিল। “আমি জানি না তোমাকে ছাড়া কীভাবে থাকব।”
রিয়া জায়ানের চুলের মাঝে আঙুল চালিয়ে দিচ্ছিল। “আমি তোমাকে ছাড়া কোথাও যাব না। ” ভালোবাসা মাখা কণ্ঠে বলল।
সেই মুহূর্তে, ওদের সম্পর্ক ছিল অবিচ্ছেদ্য,। তাদের শরীর আর অনুভূতি একাকার হয়ে গিয়েছিল। বাইরের পৃথিবী ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল, আর ওরা নিজেদের মধ্যে হারিয়ে গেল।
পরদিন সকালে রিয়া জেগে দেখল জায়ান তখনও ঘুমিয়ে ছিল। সকালের আলোয় ওর মুখে গত কয়েক দিনের ক্লান্তি কিছুটা কম মনে হচ্ছিল। রিয়া আস্তে আস্তে ওর চোয়ালের রেখা স্পর্শ করল, ভালোবাসা আর হারানোর ভয় ওর অন্তরে একসাথে দোলা দিল।
জায়ান বুঝতে পেরে রিয়াকে কাছে টেনে নিল। ওর মুখ লুকিয়ে ফেলল রিয়ার চুলের মাঝে। “আমার সাথে থেকো” জায়ান ঘুমভরা গলায় বলল, আবেগে গলা ভারী হয়ে আসছিল।
“সবসময়,” রিয়া জবাব দিল।
১৯।
রিয়াকে আবারও পুলিশের মুখোমুখি হতে হল। এবার রিয়া ভয় পেল না। একটার পর একটা যখন খুন করে যাচ্ছে তখন আর পুলিশে কিসের ভয়? রিয়া নিজের সাথে বোঝাপড়া করে নিল। এই জীবনে রিয়ার শুধু একটাই ভয়। সেটা হল জায়ানকে হারিয়ে ফেলার ভয়। আর কোন কিছু রিয়াকে তেমন একটা স্পর্শ করল না।রিয়া তাই হাসিমুখে পুলিশের মুখোমুখি হল।পুলিশ অফিসার জামান যখন আবার এল রিয়া খুব আন্তরিক ভাবে বাসার ভেতর বসাল। চা বানিয়ে দিল। চা খেতে খেতে ওরা কথা বলল, ‘বিষয়টা খুবই সিরিয়াস।পর পর দুটো মানুষ নিখোঁজ। দুজনের শেষ অবস্থান এই আখতার বাড়ি। ’ এমনভাবে অফিসার জামান কথাটা বলল যেন যেন রিয়ার সাথে কোন টপ সিক্রেট বিষয়ে কথা বলছে। ‘দেখুন ধানমণ্ডি লেক এ অনেক মানুষই ঘুরতে আসে। আর এই বাড়িটা একদম লেকের পাশেই’। রিয়া বিষয়টা উড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করে।
- তাই বলে এতটা কাকতালীয় হবার কথা নয়। মিসেস শাহানার গাড়ি খুব কাছেই পার্ক করা ছিল। সেখান থেকে একটা মাত্র রাস্তা সামনের দিকে চলে গেছে। রাস্তাটা অল্প একটু গিয়েই শেষ হয়ে গিয়েছে। এরপর একটাই বাড়ি। সেটা হল এই বাড়ি।
অফিসার জামান রহস্যের জট খোলার চেষ্টা করল।
-বুঝলাম। কিন্তু আমি এই মহিলাকে এখানে দেখি নি।
রিয়া সরাসরি অস্বীকার করে বসল। অফিসারকে কোন সুযোগ দিতে চাইল না।
-আমি এই বাড়িটা একটু ভালভাবে খুঁজে দেখতে চাই।
অফিসারের উদ্দেশ্য পরিষ্কার। তার সন্দেহের তীর এই বাড়ির দিকেই।
-আপনার কি ধারণা আমি দুটো মানুষকে এখানে লুকিয়ে রেখেছি?
-না আমরা কোন ধারণা নেই। আবার কোন সম্ভাবনাই উড়িয়ে দিতে চাই না।
- দেখুন মিসেস আখতার খুবই অসুস্থ। নিচতলা হয়ত আমি আপনাকে ঘুরে দেখাতে পারি। কিন্তু দোতলায় মিসেস আখতারের কাছে যেতে চাইলে ওনার সন্তানদের অনুমতি লাগবে। ডাক্তারের নিষেধ আছে।
রিয়া যে কোন মূল্যে এই বাসা থেকে অফিসারকে দূরে রাখার চেষ্টা করল।
- আমি ওনার সন্তানদের সাথে কথা বলতে চাই।
- ওনারা বিদেশে থাকেন।
-ওনারা কিভাবে যোগাযোগ করেন?
-ফোনের মাধ্যমে।
-তাহলে ফোন নাম্বার দিন।
-ওনাদের অনুমতি ছাড়া দেওয়া নিষেধ।
- আপনি কি জানেন চাইলে আমি এখনি তুলে আপনাকে থানায় নিয়ে যেতে পারি।
সোজা কথায় কাজ হচ্ছে না। অফিসার জামান তাই কথা বাঁকা করলেন।
- না পারেন না। পারলে আপনি এখনো আমার সাথে এত ভদ্র ব্যবহার করতেন না। আখতার ফ্যামিলি নিশ্চয় অনেক ক্ষমতাবান। হুট করে এই বাড়িতে ঢুকে খোঁজাখুঁজি করতে পারবেন না। অনুমতি লাগবে। সেটা আপানার কাছে নেই। খুব সহজে পাবেন ও না।
অফিসার জামান ভুরু কুঁচকে ফেললেন। তারপর খুব মজা পেয়েছেন এমন ভাব করে বললেন,
-হা হা। হাসালেন।
-হাসির কি বললাম।
-এই যে বললেন। আমি কিন্তু চাইলেই আপনাকে তুলে নিতে পারব।
-আমার যে ধারণা তা বললাম।
-আর কি ধারণা আছে আপনার মনে?
-আর কিছু নেই।
- হেসে ফেলার জন্য আমি সরি। আপনি নিশ্চয় অনেক কিছু ভেবেছেন। আমি হাসব বলে এখন আর বলতে চাচ্ছেন না।
- আমার সত্যিই আর কিছু বলার নেই।
রিয়া আর কথা বাড়াল না। পুলিস অফিসারকে ওর মোটেও সুবিধার মনে হল না।
- আপনি কি জানেন আপানর মাথায় অনেক বুদ্ধি?
- যদি কিছু মনে না করেন আমাকে উঠতে হবে। মিসেস আখতারকে ওষুধ দেওয়ার সময় হয়ে গেছে।
- আপনাকে ছেড়ে দিতে পারলে আমার ভাল লাগত। কিন্তু আপনি কিছু একটা লুকাচ্ছেন আমার কাছে।
- কেন এ কথা মনে হল?
-আমার কিছু মনে হয় না। যেটা ঘটে সেটাই বলি ।
এই কথা বলে অফিসার জামান ওর পকেট থেকে একটা ছবি বের করলেন। ক্যাফের সামনের ছবি। রিয়া আর তানিম দাঁড়িয়ে আছে। এটা সেই ক্যাফে যেখানে ওরা দুইজন দেখা করেছিল। আশেপাশে হয়ত কোন সি সি ক্যামেরা ছিল। সেখানে ধরা পড়েছে।
রিয়ার হাসি হাসি মুখ অন্ধকার হয়ে গেল।
-আপনি বলেছিলেন আপনি তানিম কে চেনেন না। ছবিটা ভিন্ন কথা বলল। মিথ্যে কথা কেন বলেছিলেন?
রিয়া চুপ করে থাকল।
-মিসেস শাহানাকেও কি আপনে চেনেন? দেখুন আপনি কিছু একটা আমাদের কাছে লুকাচ্ছেন। লুকিয়ে লাভ নেই। বুঝতেই পারছেন আমরা খুঁজে বের করে ফেলব। তারচেয়ে আগেই যদি আমাদের বলে দেন তাহলে আমাদের সময় বাঁচবে।
রিয়া বুঝতে পারল ওর চুপ করে থাকলে চলবে না। কিছু একটা বলে থামাতে হবে। নাহলে অফিসার জামান ওকে ছাড়বে না।
-আমি আপনাকে বলতে পারি কিন্তু আপনাকে কথা দিতে হবে আপনি কাউকে বলতে পারবেন না।
-আপনি যদি কোন অপরাধ না করে থাকেন তাহলে আমি কথা দিলাম আমি কাউকে বলব না।
-তানিম আমার প্রেমিক ছিল কিছুদিন। ওর সাথে আমার শারীরিক সম্পর্ক হয়। তানিম বিষয়টা ভিডিও করে আমাকে ব্ল্যাকমেইল করার চেষ্টা করছিল।
মিথ্যে বলল রিয়া। মিথ্যেটা ও ভালই পারে।
-প্রথমদিন কেন এ কথা বলেন নি।
-ও বলেছিল এই কথা পুলিশকে বললে ভিডিও প্রকাশ করে দেবে।
-তানিম এখন কোথায় আছে?
-আমি সত্যি জানি না। একদিন ওর ফোন মেসেজ আসা বন্ধ হল। তারপর আপনার কাছ থেকে জানতে পারলাম ও নিখোঁজ। আপনি প্লিজ এই কথাটা প্রকাশ করবেন না। ভিডিওটা ছড়িয়ে গেলে আমার আত্মহত্যা করা ছাড়া আর কোন উপায় থাকবে না। আমার জীবনটা শেষ করে দেবেন না।
ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল রিয়া। জামান কিছুটা অস্বস্তিতে পরে গেল।
-আপনি যে এখন সত্য বলছেন তার প্রমাণ কি?
-আপনি কি ভিডিওটা দেখতে চান?
-না না। ঠিক আছে।
-আপনি প্লিজ এই বাড়িতে আর আসবেন না। দরকার হলে আমাকে থানায় ডাকবেন। আপনি বার বার আমার কাছে আসলে আশেপাশের লোকজন আমাকে সন্দেহ করবে। ভাববে আমি কোন অপরাধী। পুলিশ আমার পিছে লেগে আছে।আমার চাকুরীটা চলে যাবে। কিছুদিন আগে আমার বাবা মারা গেছেন। চাকুরীটা আমার খুব দরকার।
অফিসার জামানের অস্বস্তি আরও বাড়িয়ে দিল।অপরাধী থেকে নিজেকে অপরাধের শিকার হিসেবে দেখাল। জামানের মনে একটু দয়া হল। ‘ঠিক আছে, আমার দরকার হলে আমি ডাকব’। বলে চলে গেলেন। রিয়া যেন হাফ ছেড়ে বাড়ল। অফিসার জামানের হাত থেকে মুক্তি পাওয়া গেল। কিন্তু রিয়া বুঝতে পারছে এই জয় সাময়িক।
অফিসার জামান সহজে পিছু ছাড়বে না।
২0 ।
রিয়ার নতুন দুশ্চিন্তা শুরু হল। কি করে পুলিশকে পিছু ছাড়ান যায় । রিয়া অনেক ভেবে দেখল।পালিয়ে যাওয়া ছাড়া আর উপায় নেই। কিন্তু পালিয়ে গেলে দুটো সমস্যা। জায়ানকে হারাতে হবে। অন্যদিকে ফ্রিজারে রাখা লাশ দুটো ফেলে যেতে হবে। একদিন না একদিন লাশগুলো প্রকাশ্যে আসবেই। তখন রিয়ার সব অপকর্ম ফাঁস হয়ে যাবে। সারাজীবনের জন্য রিয়া হয়ে যাবে পলাতক আসামি। রিয়ার মনে হল এই বাড়িটাকে যদি মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে পারত? তাইলে পালিয়ে গিয়ে শান্তি পেত। কিন্তু জায়ানকে কি বলবে? জায়ানের সাথে ওর সম্পর্কটা গড়ে উঠেছে এই বাড়িকে কেন্দ্র করে। এই বাড়ি থেকে যদি ও পালিয়ে যায় তাহলে বিষয়টা কিভাবে ব্যাখ্যা করবে? নাকি জায়ানকে পালিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দিবে? প্রেমের টানে দুইজন হাত ধরে ঘর ছাড়ল। তারপর দুজন যেদিকে দুচোখ যায় চলে গেল। কিন্তু জায়ান কি রাজি হবে? এই শহরে ওর বেড়ে ওঠা, ওর চাকুরী, ওর হারিয়ে যাওয়া মাকে খুঁজে বেড়ান। এসব বাদ দিয়ে জায়ান কি ওর কথায় রাজি হবে? তাছাড়া নতুন জায়গায় গিয়ে ওরা থাকবে কোথায়? খাবেই বা কি? নাহ কোন সমাধানই রিয়ার মন মত হচ্ছে না।নিজের রুমে বসে দুশ্চিন্তা করতে লাগল।
জায়ান এর ফোন এল।
-হ্যালো
-কি করছ সোনা?
-তেমন কিছু না। তুমি কোথায়?
-অফিস থেকে বের হলাম। ভাল লাগছে না। ভাবছি আজ রাতে তোমার বাসায় আসি।
রিয়ার হাতে খুব একটা সময় নেই। ও চাচ্ছেনা আজকে জায়ান এ বাড়িতে আসুক। ওকে একটা সমাধান খুঁজে বের করতে হবে। প্রেম পরেও করা যাবে।
-আজকে আসা যাবে না।
-কেন ?
-দাদির শরীরটা সুবিধে মনে হচ্ছে না। আমাকে ওনার পাশে থাকতে হবে।
-কি হয়েছে?
-ওই সবসময় যা হয়। ওনার কি রোগের অভাব?
-কিন্তু আমি যে খুব মিস করছি তোমাকে।
-একটা রাতইত ময়না। তুমি না হয় বন্ধুদের সাথে আড্ডা দাও।
-জো হুকুম আমার রানি।
-লাভ ইউ ময়না।
-লাভ ইউ টু সোনা।
রিয়া ফোন রাখল।
লাশগুলো এই বাড়ি থেকে সরিয়ে ফেলার কি কোন উপায় আছে? এই বাড়িতে লাশ রাখা আর ওর কাছে নিরাপদ বলে মনে হল না। লাশ কেটে টুকরো করে লুকিয়ে ফেলা যায় সেরকম কি কিছু করবে? রিয়া স্টোর রুমে লাশ গুলো দেখতে গেল। জমে বরফ হয়ে আছে। ওর মনে হলে ওর একার পক্ষে সম্ভব না। এক রুম থেকে আরেক রুমে লাশগুলো আনতেই খবর হয়ে গিয়েছিল। সেখানে এগুলো বের করে কাটাকাটি করা, সেগুলো আবার লুকানো? অনেক কঠিন কাজ। একটা মুরগি কাটতেই ওর দমবন্ধ লাগে, সেখানে আস্ত দুটো মানুষ। রিয়া এই প্লান বাদ দিল।
-কিরে কি করছিস?
রিয়ার চমকে উঠল। মিসেস আখতার স্টোর রুমের দরজায়। নিজের অটোমেটেড হুইলচেয়ারে করে এসেছেন। ওনাকে আজ অবধি দুইতলায় দেখেছে। নিজ রুম থেকে কখনো বের হতে দেখে নি। এই বাড়িতে দোতলা থেকে নিচতলায় নামার জন্য আলাদা লিফট আছে।লিফট ব্যবহার করে নেমেছেন বোধহয়।
-আপনি নিচতলায়?
-অনেকক্ষণ ধরে তোকে ডাকার কলিংবেল দিচ্ছিলাম। কোন খবর নেই। তাই বাধ্য হয়ে নিচে নামলাম। তোর আবার কিছু হল কিনা?
-কলিংবেল বেজেছে? কই আমিত শুনি নি।
রিয়া অল্প অল্প ঘামতে শুরু করল। মিসেস আখতার কিছু দেখে ফেলল নাত?
-কি জানি। আমিত বাজাচ্ছিলাম। নষ্ট মনে হয়। তুই এই রুমে কি করছিস?
-আমার একটা ব্যাগ খুঁজে পাচ্ছি না । ভাবলাম ভুলে এই রুমে রাখলাম নাকি। তাই খুঁজতে এসেছি।
আর কিছু বলার মত পেল না রিয়া। মিসেস আখতার আরও প্রশ্ন করতে লাগলেন,
-এই ফ্রিজটা চলছে কেন?
-আমি চালু করে দেখলাম। ঠিক আছে কি না।
-ভেতরে কি আছে? এটাত ফাঁকা থাকার কথা।
-কিছু পুরানো জিনিস।
রিয়া থপ করে ফ্রিজের দরজা বন্ধ করে দিল। স্টোর রুম থেকে বের হয়ে হল।
-এখানে আপনার থাকার দরকার নেই। অনেক ধুলা। আপনার ধুলার ভেতর থাকা নিষেধ। চলুন আপনাকে রুমে দিয়ে আসি।
-তুই ফ্রিজটা বন্ধ করে আসিস নি।
-আপনাকে রুমে দিয়ে এসে করছি।
রিয়া হুইল চেয়ার টেনে নিয়ে চলল। মিসেস আখতার কি বুঝতে পেরেছে? ফ্রিজ চলতে দেখে তার মনে খটকা লেগেছে। এর পর যদি নিজে নিজে এসে চেক করে? এখন রিয়া কি করবে? বিপদ যখন আসে তখন চারপাশ দিয়েই আসে। রিয়া আর কিছু ভাবতে পারল না। মিসেস আখতার রিয়ার গোপন সত্যগুলো জেনে যেতে পারে। তাহলে কি তানিম আর জায়ানের মার মত মিসেস আখতারকেও?
রিয়া কোন রিস্ক নিতে চাচ্ছে না।
সেই রাতে, যখন মিসেস আখতার ঘুমিয়ে ছিলেন, রিয়া সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল।
রাতের নিরবতায় ও ঘুমের ইঞ্জেকশন প্রস্তুত করে ফেলল। একটু বেশি পরিমাণেই নিল।পুরোপুরি নিশ্চিত করত করতে হবে যে তিনি আর কখনো জেগে উঠবেন না।
রিয়া যখন মৃদু আলোয় মিসেস আখতারের ঘরে প্রবেশ করল, বাতাস যেন ভারী হয়ে উঠল।
ও আস্তে করে বৃদ্ধার কপালে হাত বুলিয়ে দিল, “শান্তিতে ঘুমান।”
অভিজ্ঞ হাতে রিয়া ইনজেকশনটি প্রবেশ করাল। মিসেস আখতারের শ্বাস ধীর হয়ে এল, তারপর একসময় থেমে গেল। রিয়া তার পাশে কিছুক্ষণ বসে রইল। ওর মনে কোনো ভয় ছিল না। কোনো দ্বিধা ছিল না—শুধু একনিষ্ঠ সংকল্প।
এইবার রিয়া লাশ লুকানোর প্রয়োজন বোধ করল না। মিসেস আখতারের সন্তানরা জানত যে তাদের মা খুব অসুস্থ। যে কোন মুহূর্তে তার মারা যাবার খবর আসতে পারে। রিয়া পরদিন সকালে ফোন করে তাদের মিসেস আখতারের মারা যাওয়ার খবর জানাল। তারা কষ্ট পেল কিন্তু এই ধরনের খবরের জন্য তৈরি ছিল। দেশে আসার জন্য রওয়ানা দিল সবাই।
“আমরা জানাজার ব্যবস্থা করব,” বড় ছেলে সংক্ষেপে বলল। “এতদিন মায়ের পাশে থাকার জন্য ধন্যবাদ”
দুইদিনের মধ্যে বাড়ি শোকগ্রস্ত মানুষে ভরে উঠল—ব্যবসায়িক পরিচিত, দূরসম্পর্কের আত্মীয়স্বজন এবং কিছু মানুষ যারা শুধুমাত্র সামাজিক দায়িত্ব পালনের জন্য এসেছিল। জায়ানকে সবকিছু থেকে আড়ালে রাখল রিয়া, বলল এটি ওর পরিবারের ব্যক্তিগত সময়।এ সময়টা একটু দূরে থাকতে চায়। ও জানিয়ে দেবে আবার কখন জায়ান আসতে পারবে।আপাতত কয়েকদিন যোগাযোগ বন্ধ রাখতে হবে।
দাফনের পর মিসেস আখতারের সন্তানরা বসার ঘরে একত্রিত হলো। সম্পত্তির ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা করতে লাগল। রিয়ার মাথায় একসাথে অনেক চিন্তা খেলা করতে লাগল। মিসেস আখতার এই মুহূর্তে মারা যাওয়ায় ওর কয়েকটা সুবিধা হল। জায়ানের মত পুলিশ অফিসার জামানকেও এই বাড়ি থেকে কিছুদিন দূরে রাখতে পারল।মরা বাড়িতে নিশ্চয় এসে আর পুলিশি ঝামেলা করবে না।এখন কি মিসেস আখতারের সন্তানেরা রিয়াকে এই বাড়ি থেকে বের করে দেবে? এখনত আর রিয়ার কাজ নেই। মিসেস আখতারের দেখাশোনা করার কিছু নেই। বের করে দেবে না মনে হয়। মিসেস আখতারের ছোট মেয়ে একবার রিয়াকে বলছিল, আল্লাহ না করুক মায়ের কিছু হয়ে গেলেও তুই এই বাসায় থাকবি। তোকে আমরা বোনের মত দেখি। তুই নিজের মত থাকবি। আমরা মাঝে মধ্যে দেশে আসলে আমাদের সাহায্য করবি।
“তুমি আমাদের মায়ের জন্য যা করেছ, তার জন্য কৃতজ্ঞ,” বড় ছেলে বলল। কণ্ঠস্বর ছিল একেবারেই নিরুত্তাপ। “তুমি চাইলে এখানে থাকতে পারো যতদিন ইচ্ছে।” ওদের পারিবারিক মিটিং শেষ করে রিয়াকে সিদ্ধান্ত জানান হল।
রিয়া বিনীতভাবে কৃতজ্ঞতার ভাব ফুটিয়ে তুলল। চোখ নিচু করল। “ধন্যবাদ। আমি নিশ্চিত করব, বাড়ির সব কিছু ঠিকঠাক থাকবে।” ওর আনন্দে বুক নাচছিল। রিয়া আরেকটি বাধা সরিয়ে দিল। এখন পুরো প্রাসাদ ওর একার দখলে।
সেদিন রাতে ও যখন বিছানায় গেল তখন দেখল একটা চিঠি। এটা এমন এক চিঠি যেটার কথা রিয়া কখনো কল্পনাও করে নি।
২১।
রিয়া,
চিঠিটা যদি তুই হাতে পেয়ে থাকিস তাহলে এতক্ষণে আমি মারা গেছি। তোকে আমার ছেলে মেয়েরা এ বাড়িতে আরও কিছুদিন থাকার অধিকার দিয়েছে। অবাক হয়েছিস, ভাবছিস মিসেস আখতার মারা যাবার পরও এত কিছু কিভাবে জানে? চিঠিই বা কিভাবে লিখল? তোকে সব জানানোর জন্যই এই চিঠিটা লেখা। আসতে আসতে সব ই তোর কাছে পরিষ্কার হবে। আমি তাহলে শুরু থেকে বলি। তোর বুঝতে সুবিধে হবে। আমি যখন আখতারকে বিয়ে করি তখন আমারা এত ধনী ছিলাম না। ভালবেসে বিয়ে করেছিলাম। টাকার দিকে তাকাই নি। পরিবারের অমতে গিয়ে বিয়ে করেছিলাম। আমার পরিবার থেকে কোন সাহায্য করছিল না। আখতারের পরিবারের অত টাকা ছিল না। আখতার তখন চাকুরী করত না। ভালই অর্থ কষ্টে পরেছিলাম। আখতারকে ভালবাসি বলে সেটা মেনে নিয়ে ছিলাম। এর মাঝেই আমাদের প্রথম সন্তান হল। টাকা পয়সার কষ্ট অনেক বেড়ে গেল। আখতার খুব মন খারাপ করে থাকত।বাচ্চার জন্য ঠিকমত দুধ কেনার পয়সা থাকত না । আমার ওর এই মন খারাপ করা মুখ দেখতে অনেক কষ্ট হত। আমি সারা রাত আল্লাহর কাছে কান্নাকাটি করতাম। আল্লাহ তুমি ওর এই অর্থ কষ্ট দূর করে দাও। ওর কষ্ট মাখা মুখ আমি আর দেখতে পারছি না। আল্লাহ আমার কথা শুনলেন। এক ব্যবসা থেকে আমাদের হু হু করে টাকা আসতে লাগল। অল্প সময়েই আমরা ধনী হয়ে গেলাম। কিন্তু প্রকৃতির মনে হয় নিয়ম আছে। কিছু পেতে হলে কিছু হারাতে হয়। আমি অনেক টাকা পেলাম ঠিকই কিন্তু আখতারকে হারালাম।আখতার হুট করেই হার্ট এটাক করল। আখতারকে হারিয়ে টাকা পয়সা আমার কাছে অর্থহীন লাগত। আমার মরে যেতে ইচ্ছে করত। কিন্তু সন্তানদের মুখের দিকে তাকিয়ে বেঁচে রইলাম।ওদের কে বড় করে তুললাম। বিদেশে সেটেল করলাম। একদিন সব দায়িত্ব শেষ হল। এরপর আর আমার বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করত না। খালি মনে হত মরে যাই । মরে গিয়ে আখতারের কাছে চলে যাই। কিন্তু আত্মহত্যা করতে পারছিলাম না। নিজেকে মারলে দোজখে যেতে হবে। সেখানেত আর আখতার নেই। আখতার বেহেশতে আছে। আমাকে বেহেস্তে যেতে হবে। তাই নিজের শরীরের প্রতি অবজ্ঞা করা শুরু করলাম। ছেলেমেয়ের সাথে বিদেশে গেলাম না। একা এই বাড়িতে রয়ে গেলাম। নিজেকে অযত্ন করতে লাগলাম। কিন্তু লাভের লাভ কিছু হল না। মারা গেলাম না। অসুস্থ হলাম ঠিকই। ডাক্তাররা চিকিৎসা দেয়। আবার সুস্থ হই। ছেলে মেয়েরা মিলে কাজের লোক ঠিক করে রাখত। আমি ওদের সাথে বাজে ব্যবহার করে তাড়িয়ে দিতাম। মনে মনে নিজের মৃত্যু চাইতাম। কিন্তু মরলাম না। এমন সময়ে তুই আমার কাছে আসলি। তোকে দেখে মনে হয়েছিল সবগুলা কাজের লোক থেকে আলাদা। ছোট খাট মিষ্টি চেহারার মানুষ। চোখ ভর্তি স্বপ্ন। দেখে কাজের লোক মনে হয় নি। মনে হয়েছিল কাজের লোক হয়ে তুই থাকবি না। তুই বড় কিছু হবি। তাই হল।তুই পালিয়ে গেলি। দুইদিন পর আবার ফিরে এলি। আমার মনে সন্দেহ ঢুকল। মনে হচ্ছিল তুই কোন আলাদা প্লান নিয়ে আসছিস। কাজের লোক হয়ে থাকার জন্য তুই আসিস নাই। আমি তোর উপর নজর রাখতে বললাম। তোর খটকা লাগে নি? এত বড় বাড়ি অথচ এই বাড়িতে কোন দারওয়ান নেই। নেই কোন সি সি ক্যামেরা। তুই যা ইচ্ছে করে বেড়াতে পারছিলি। তোকে কেউ কিছু বলছিল না। আসলে আমার দারওয়ান আছে। বাসা থেকে বের হতেই একটা ছোট পানের দোকান দেখেছিস না? ওই দোকানের লোক তাই আমার দারওয়ান। ওর কাজ হচ্ছে এই বাড়ির উপর নজর রাখা। উলটাপালটা কিছু দেখলে আমাকে এসে জানানো। বিষয়টা একটু নাটকীয় লাগছে? আসলে এটা আখতার এর বুদ্ধি। ও লুকিয়ে লুকিয়ে নজর রাখা পছন্দ করত। আখতার মারা যাবার পড় আমিও এই ব্যবস্থা চালু রেখেছি। ওর নাম জয়নাল। জয়নাল তোর উপর নজর রাখছিল। তোর আমাকে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে বাইরে যাওয়া, প্রেম করা, খুন করা এসব আমি সাথে সাথেই জানতে পেতাম। তাহলে চুপ করে ছিলাম কেন? চাইছিলাম তুই অপরাধ করতে থাক। এক সময় আমি গিয়ে হুট করে তোর সামনে দাঁড়াব । তখন তুই অপরাধ গোপন রাখার জন্য আমাকে খুন করবি। আরেকজন খুন করলেই আল্লাহ নিশ্চয় আমাকে দোজখে পাঠাবে না। আমি তখন বেহস্তে আখতারের কাছে যেতে পারব। তাই যখন দেখলাম তুই স্টোর রুমে লাশগুলো নিয়ে কিছু একটা করছিস আমি গিয়ে তোর সামনে দাঁড়ালাম। এরপরের ঘটনাত তুই ঘটালি সব। চিঠিটা আমি জয়নালকে আগেই দিয়ে রেখেছিলাম । আমি মারা যাবার পর যেন তোর কাছে পৌঁছায়।তোকে ধন্যবাদ। তুই খুনের মাধ্যমে আমাকে মুক্তি দিয়েছিস। ভাবিস না। তোকে আমি খালি হাতে ছেড়ে দেব না। আমার ইচ্ছে তুই পূরণ করেছিস। বিনিময়ে তোর ইচ্ছেও তোকে পূরণ করতে দেব। তার আগে তোকে আর কয়েকটা কাজ করতে হবে। খুব কঠিন কিছু না। চিঠিটা নিয়ে ওই পানের দোকানে দিবি। তারপর জয়নাল ফ্রিজারের ভিতর তোর লুকিয়ে রাখা লাশ গুলো নিয়ে যাবে। এমন কোন ব্যবস্থা করবে যেন ওগুলোর আর কোন অস্তিত্ব না থাকে। লাশ পাওয়া না গেলে তোর অপরাধ কেউ প্রমাণ করতে পারবে না।জয়নাল কে নিয়ে ভয় নেই। ওর নিজের জীবন চলে যাবে তবু তোর গোপন সত্য কাউকে বলবে না। এরা পুরানো দিনের বিশ্বস্ত লোক। এরপর তোকে ছোট একটা নাটক করতে হবে। আখতার বাড়ি আমি আর রাখতে চাই না। যেই সম্পদ অর্জন করতে গিয়ে আমি আখতার কে হারিয়েছি সেই সম্পদে গড়া হয়েছিল এই বাড়ি। আমি চাই এই বাড়ি ধ্বংস হয়ে যাক। আমি জয়নালকে বলে রেখেছি। ও এই বাড়িটা আগুনে পুড়িয়ে দেবে। তুই শুধু সবাইকে এমন ভাবে বলবি যেন এটা একটা দুর্ঘটনা।আমি আমার ছোট মেয়ের কাছে অনেক প্রশংসা করেছি। আমি নিশ্চিত ওরা তোকে আমি মারা যাবার এই বাড়িতে থাকতে হবে। তখন এই বাড়ির দায়িত্ব থাকবে তোর হাতে। তুই যা বলবি সবাই তাই বিশ্বাস করবে। তুই অনেক সাজিয়ে মিথ্যে বলতে পারিস। বিনিময়ে তোর থাকার জন্য একটা বাসার বাবস্থা করে রেখেছি । সেখানে গিয়ে থাকবি। তোর বেতন দেয়ার নাম করে তোর নামে একটা ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট আমি করে রেখেছি। সেখানে তোর নামে বেশ কিছু টাকা জমা করে রেখেছি। সব কাজ ঠিক করে শেষ হলে সেই অ্যাকাউন্ট তোর হাতে তুলে দেয়া হবে। তোর বেশ কিছু বছর ভালভাবে কেটে যাবে। কি মনে হচ্ছে আমার জন্য এইটুকু করতে পারবি না? জীবন তা আসলে এমনি বুঝলি। তুই ভাবছিলি সব কিছু তোর ইচ্ছে মত চলছে। অথচ তুই ছিলি আমার হাতের পুতুল মাত্র। আবার এমন কোন দিন আসবে তুই কাওকে তোর হাতের পুতুল বানাবি। আমার এই ঘটনাটা তোর জীবনের জন্য একটা শিক্ষা। জীবনে কখনো সব জেনে বসে আছিস এরকম ভাববি না। জীবন ক্ষণে ক্ষণে রং বদলায়। তুই তখনই টিকে থাকবি যখন সেই রঙের সাথে নিজেকে বদলে নিতে পারবি। শেষ মুহূর্তে তোকে একটা উপদেশ দেই। অতিরিক্ত কোন কিছুই ভাল না। তেমনি কাউকে অতিরিক্ত ভালোবাসাও ঠিক নয়। নিজের ক্ষতি হয়।তুই বুদ্ধিমতী। আশা করি এর থকে বেশি তোকে বলার নেই। আল্লাহ তোর মনের সকল ইচ্ছেগুলো পূরণ করুক।
ইতি,
মিসেস আখতার।
২২।
মিসেস আখতারের চিঠি মত সব কাজ শেষ হল। সপ্তাহ খানেক সময় লাগল। রিয়া নিজের ফ্ল্যাট আর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট বুঝে পেল। ফ্ল্যাটে বসে বসে এক নির্জন দুপুরে রিয়া নিজের জীবন নিয়ে ভাবছিল। ও ভেবেছিল জীবনটা নদীর মত। সেখানে কিছু না বুঝেই ঝাপ দিয়েছিল।ভেবেছিল সাঁতরে কোন এক ভাবে তীরে উঠে যাবে। কিন্তু রিয়া পারল না। বরং নদী ওকে সমুদ্র নিয়ে ফেলল। কুল কিনারা কিছু নেই। রিয়া তাই সাতার কাটার কোন চেষ্টা করছে না। স্রোতে গা ভাসিয়ে দিল। সবকিছু ওকে কোথায় নিয়ে থামাবে ও জানে না। ও শুধু ভেসে থাকার চেষ্টা করছে।
আর জায়ান? ওর দিকছাড়া সমুদ্রের এক মাত্র ধ্রুবতারা।ওর জীবনের সব। ওর ভালবাসা। ওর বুকের স্পন্দন। জায়ান যখন ওর আসে পাশে থাকে তখন আর এসব কিছু ওর মনে থাকে না। ওর প্রতিটা জিনিস রিয়ার ভাল লাগে।ইচ্ছে করে সারাটা সময় জায়ানকে বুকের মধ্যে আগলে রাখে। ভালবেসে এত সুখ কেন? রিয়ার মনে হয় বিধাতা ইচ্ছে করেই জীবন তা এত কঠিন বানিয়েছে। আর তার ক্ষতিপূরণ হিসেবে ভালোবাসা দিয়ে দিয়েছে। যেন মানুষ ভালবাসার দিকে তাকিয়ে সব ভুলে থাকতে পারে। রিয়াও জায়ানের দিকে তাকিয়ে সব ভুলে থাকার চেষ্টা করে। যদিও রিয়া খুব দুশ্চিন্তায় ছিল। আখতার বাড়ি থেকে বের হয়ে গেলে ও জায়ানকে কি বলবে? তখনত মিসেস আখতারের নাতনি বলে মিথ্যে অভিনয় করা ওর জন্য কঠিন হয়ে যাবে।রিয়া এখন শুধু ফোনে কথা বলছে। দেখা করছে না। এমনকি রিয়ার নতুন ফ্ল্যাটের ঠিকানাও জায়ানকে দিচ্ছে না। ও ইচ্ছে করেই জায়ানকে ওর থেকে দূরে রেখেছে। নতুন পরিস্থিতির সাথে ও নিজেকে আগে একটু মানিয়ে দিতে চায়। ফ্ল্যাটটা কার? রিয়া কোত্থেকে পেল? কতদিন এখানে থাকবে? একা একা কেন থাকছে সেসবের গোছানো উত্তর জায়ানকে দিতে হবে। এসব উত্তর মেলাতেই রিয়া একটু সময় নিচ্ছে। সব সময়ের মত এবারও খুব সুন্দর করে মিথ্যে বলতে হবে। একদিন ফোনে কিছুটা মিথ্যে বলার চেষ্টা করেছে।
-রিয়া তোমার সাথে দেখা করতে খুব ইচ্ছে করছে। কতদিন আমাদের দেখা হয় না।
- এইত আর কয়টাদিন সোনা। খুব শীঘ্রই আমাদের দেখা হচ্ছে।
- কোথায় আছ সেটাওত আমাকে বলছ না। তোমাদের বিখ্যাত আখতার বাড়িত আগুনে পুড়ে থাকার মত নেই এখন।
- আমার এক মামার ফ্ল্যাটে।
-আর কে আছে ওখানে?
- কেউ নেই। ওনারাও বিদেশ থাকে। এটা ফাঁকা ছিল। আমাকে তাই আপাতত থাকতে বলা হয়েছে।
- তাই বলে তুমি একা থাকবে? সাথে আর কেউ নেই থাকার মত?
- একা আছি। সম্ভবত একাই থাকতে হবে। ফ্যামিলির সাথে ঝগড়া হয়েছে আমার।
- কেন?
-ওনারা আমাকে এখনি নিয়ে যেতে চাচ্ছে। কিন্তু আমি দেশ ছেড়ে যেতে চাচ্ছি না। বলেছি যে আমার এনজিও এর কাজগুলো এখনো শেষ হয় নাই। আর কিছুদিন থাকতে চাই। কিন্তু কিছুতেই একা থাকতে দিতে রাজি হচ্ছে না। বলেছে যে এখন যদি না যাই তাইলে আর যাওয়ার দরকার নেই।
- তুমি একা কোথায়? আমিত আছি।
- সেটা কি আর বলা যায়। প্রেমিকের জন্য আমি দেশ ছেড়ে যেতে চাচ্ছি না? এটা শুনতে কেমন দেখায়? আমাকে আরও আগে এসে জোর করে নিয়ে যাবে তাইলে।
- তাহলে কি করবে এখন?
- একাই থাকব আপাতত।যাওয়ার জন্য জোরাজুরি করলে আমি ফ্যামিলির সাথে যোগাযোগ করাই বন্ধ করে দেব।
- এটা কি ঠিক হবে? ফ্যামিলি খুব ইম্পরট্যান্ট।
-কেন? তুমি কি ফ্যামিলি ছাড়া মেয়েকে আর ভালবাসবে না?
-আমার ভালবাসার কথা আবার আসল কেন? আর তোমার চেয়ে আমার ফ্যামিলিরত বাজে অবস্থা। বাবা ছেড়ে গেছে, মা নিখোঁজ। আমি এতিম। তুমি কি একটা এতিম ছেলেকে মেনে নেবে?
- এতিম কেন হবে? মামা চাচারা নিশ্চয়ই আছে?
- আমার আসলে কোন আত্মীয় সজনের সাথে যোগাযোগ নেই। বাবা মাকে ছেড়ে চলে যাবার পর মা কিছুটা বেপরোয়া হয়ে যান। ব্যবসা এর অজুহাতে প্রায়ই বাইরে থাকতেন। পর পুরুষদের সাথে মেলা মেশা করতেন। ধর্ম কর্ম, প্রেম ভালবাসা এগুলা বিশ্বাস করা বাদ দিয়ে দিলেন। আত্মীয়রা এসবে বাঁধা দিতে চাইলে তিনি তাদের থেকে দূরে সরে গেলেন। মার সাথে সাথে আমারও তাই তাদের সাথে অত যোগাযোগ নেই।
কথাগুলো রিয়াকে এক ধরণের ভরসা দেয়। জায়ানকে পুরোপুরি ওর করে পাবার পথে তাইলে তেমন কেউ বাঁধা হয়ে দাঁড়ানোর মত নেই।তারপরও রিয়ার ভয় হয়। মায়ের কোন প্রভাব কি জায়ানের মনের উপর আছে?
- তুমি কেন আমাকে এত ভালোবাস জায়ান?
-আসলে আমার মতে ভালবাসা জিনিস তা এক এক জনের কাছে এক এক রকম। মার ভালবাসা চলে গিয়েছে বলে তিনি ভালবাসায় বিশ্বাস হারিয়েছেন। আর আমার কাছে ভালোবাসা মানে হলে তুমি। আমার যখন মন খারাপ হয় তখন চোখ বন্ধ করে তোমার কথা ভাবি। সেই নিল শাড়ি পড়া হাতে ফুল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটি, যাকে নিয়ে বৃষ্টির দিনে আমি ভিজেছিলাম। আমার মন ভাল হয়ে যায়। ভালবাসলে হয়ত কষ্ট পেতে হয় অনেক, কিন্তু এমন সুখের মুহূর্তওত পাওয়া যায়।যেই মুহূর্তের কথা ভেবে সারা জীবন কাটিয়ে দেয়া যায়।
কথাগুলো রিয়ার কানে সুমধুর কোন সঙ্গীতের মত বাজতে থাকে। এত ভাল লাগে ওর। রিয়ার মনে হল ও ভুল করে নি। জায়ানের জন্য দুইটা কেন ও হাজারটা খুন করতে পারে। রিয়া ফ্ল্যাটটাকে নিজের মত করে সাজাতে থাকে। একদিন মন ভরে শপিং করল। জায়ানের জন্য সুন্দর সুন্দর কিছু গিফট কিনল। রিয়া ঠিক করল যেদিন আকাশটা একটু মেঘলা মেঘলা হবে সেদিন ওকে আসতে বলবে। জায়ানের জন্য নিজ হাতে রান্না করবে। সেদিন রাতে রিয়া জায়ানকে ওর ভালবাসার কথা জানাবে। বলবে আমি জনম জনম ধরে তোমায় ভালবেসে যেতে চাই? সেই পথে তুমি কি আমার সঙ্গী হবে?
২৩।
সেই দিন মেঘলা ছিল। রিয়ার মনে হল আজকেই সেই দিন। এমন দিনেই জায়ানকে ভালবাসার কথাগুলো বলা যায়।ওকে বিকেলে আসতে বলবে। শাড়ি পড়া জায়ানের খুব পছন্দ করে। রিয়া ঠিক করল শাড়ি পড়বে। তার আগে রান্না বান্না শেষ করে ফেলতে হবে।জায়ান যদি ব্যস্ত থাকে? না মনে হয়। সেরকম কিছু থাকলে আগে থেকেই রিয়াকে বলত। তাছাড়া যত ব্যস্তই থাকুক না কেন জায়ানকে আসতেই হবে। রিয়া এমন ভাবে বলবে যেন জায়ান না বলতে না পারে। রিয়া সব কাজ গুছিয়ে তারপর ফোন দেবে ভেবে রাখে। কিন্তু সেদিন আর ফোন দেয়া হল না। পুলিশ এসে রিয়াকে ধরে নিয়ে গেল। একটা অন্ধকার রুমে আটকে রাখল। কিছু লোক এসে ওকে প্রচণ্ড মারধর করল। রিয়া প্রায় অচেতন হয়ে গেল। প্রথম দিকে খুব ব্যথা লাগছিল। ও কুঁকড়ে যেতে থাকেল। এরপর থেকে যতই মারে ওর গায়ে সয়ে গেল। এক ধরণের ভোঁতা যন্ত্রণা হতে থাকল শুধু। এরা কি রিয়াকে মেরে ফেলবে? মেরে ফেললে তো একবারেই মারতে পারে। এত মারধর করার কি আছে? রিয়াকে কেউ কিছু বলল না। এক সময় মারতে মারতে ক্লান্ত হয়ে যায়। তারপর থামল। কয়েকজন মিলে ধরে প্রায় অচেতন রিয়াকে একটা চেয়ারে তুলে বসাল। ওর হাত পা চেয়ারের সাথে বেঁধে ফেলেল। কতক্ষণ এমন অবস্থায় ছিল ওর মনে নেই।পরিচিত কণ্ঠে ও মাথা তুলে তাকানোর চেষ্টা করল। ওর চোখের পর্দা খুব ভারি লাগছিল। খুলতে খুব কষ্ট হচ্ছিল। কোন রকমে খুলে দেখল। অফিসার জামান। ওর সামনে বসে আছে।
-কেমন আছেন রিয়া?
রিয়া কোন কথা বলার মত নেই। কোনরকমে চোখ খোলার চেষ্টা করে আবার বন্ধ করে ফেলেল।অফিসার জামান কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। তারপর নিজেই বলা শুরু করল,
‘দেখুন মারামারি আমি পছন্দ করি না। অপরাধ করলেও সবাই মানুষ। আমি সবাইকে সম্মান করি। এমনকি কাউকে তুই তুকারিও করি না। সে যত বড় অপরাধই করুক না কেন।’
বলে একদলা থুতু ফেলল। যেন কথাটা নিজে তেমন বিশ্বাস করে না।
‘কিন্তু সবাইত আর আমার মত না। পুলিশের সময়ের দাম আছে । ভদ্রতা করলে অনেকে দুর্বল ভাবে। তাই সময় বাঁচানোর জন্য গায়ে হাত তোলে। তানিম এবং মিসেস শাহানার মিসিং কেসে আপনি ভুলভাল তথ্য দিয়ে আমাদের বেশ কিছু সময় নষ্ট করেছেন। তাই আপনার গায়ে হাত তোলা হয়েছে। আমাদের হাতে সময় খুব কম। আপনি যা জানেন তা যদি আমাদের বলে দেন আমাদের এসবের ভেতর দিয়ে যাওয়ার দরকার পরে না। ’
অফিসার জামানের কথা রিয়ার মাথায় ঠিক করে ঢুকছিল না। ওর গা গুলাচ্ছিল। রিয়া বমি করে দিল।
ওকে বমি করতে দেখে জামান কথা একটু থামল। বমি শেষ করলে আবার বলা শুরু করল। যেন কিছুই হয় নি।
‘আপনি আমাদের না বললেও আমরা সব জানি।জয়নাল আমাদের হাতে বন্দি। ও সব কিছু স্বীকার করে নিয়েছে। আমাদের হাতে প্রমাণও আছে। আমরা আলাদা করে আখতার বাড়ির উপর নজর রাখছিলাম। জয়নালের সন্দেহজনক গতিবিধি আর আপানর সাথে জয়নালের চিঠি দেয়া নেয়া আমাদের নজরে আসে। ওকে ধরে আনা হয়েছে।ওর কাছ থেকে তথ্য নিয়ে তারপর আপনাকে ধরা হল। ’
রিয়া কোন রকমে চোখ খোলার চেষ্টা করে।ওর চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। ঝাপসা চোখে লক্ষ্য করল জামানের হাতে একটা আংটি। অফিসার জামান কি বিয়ে করেছে? উনি কি প্রেম করেছিলেন? আচ্ছা জামান সাহেব, আপনি কি বলতে পারবেন ভালোবাসা আসলে কী ? কিসব আবোল তাবোল ও ভাবছে? রিয়া নিজের চিন্তা ভাবনা গোছানোর চেষ্টা করে। ওর শরীরে অসহ্য যন্ত্রণা আবার বাড়তে শুরু করেছে।
অফিসার জামান বলে যাচ্ছিল, ‘জয়নাল আমাদের সব বলেছে। কেন আপনি এই কাজ করলেন? জয়নালের সাথে আপনার কি সম্পর্ক? তানিম এবং মিসেস শাহানাকে কোথায় লুকিয়ে রেখেছেন? আপনার নেক্সট...
রিয়া আর শুনছিল না। লুকিয়ে শব্দটা ওর মাথার ভিতর ঘুরতে লাগল। এরা তাহলে জানে না তানিম আর জায়ানের মা বেঁচে নেই। জানলে লুকিয়ে রেখছে বলত না। বলত লাশ কি করেছে? আন্দাজে ঢিল ছুড়ে রিয়ার কাছ থেকে কথা বের করার চেষ্টা করছে। মিসেস আখতার বলেছিল জয়নাল মরে যাবে তবু মুখ খুলবে না। মিসেস আখতারের নিশ্চয় মানুষ চিনতে ভুল হওয়ার কথা না। রিয়া কোন রকমে ইশারায় অফিসার জামানকে কাছে ডাকল। তারপর ফিসফিস কোন রকমে বলল, জয়নাল বোবা।
অফিসার জামানকে বিভ্রান্ত দেখায়। ও পাশে থাকা জুনিয়র অফিসারের দিকে তাকায়। সত্যি সত্যিই জয়নাল মুখ খুলে নি। অনেক মার খেয়েছে তবু একটা টু শব্দ করেনি। জয়নাল কি সত্যিই বোবা? জুনিয়র অফিসার নিশ্চিত হবার জন্য বের হয়ে গেল। জামান বুঝতে পারল রিয়াও মুখ খুলবে না। তবে ওনার কথা বের করার কৌশল রিয়া এত সহজে ধরে ফেলায় কিছুটা অপমান বোধ করলেন। তিনি উঠে গেলেন।রিয়াকে আবার মারতে লাগল। রিয়ার প্রতিটা কোষ যন্ত্রণায় ছটফট করছিল। ও অচেতন হয়ে গেল।কিছুক্ষণ পর ওর মুখে পানি মারা হল। আবার অফিসার জামানের সামনে বসান হল। এবার অফিসার জামানের মুখে বিজয়ের হাসি।
‘আপানর ফোনের কললিস্ট বের করা হয়েছে। একটা নাম্বারের সাথে আপানর অনেক কথা হয়। নাম্বারটা হল মিসেস শাহানার ছেলে জায়ানের।নিশ্চই আপানার প্রেমিক হবে। আমরা তাহলে কেস সলভ করে ফেলেছি। কিসের জন্য খুন করেছিলেন? টাকার জন্য? মিসেস শাহানা অবশ্য বড় বড় বেশ কিছু সরকারি প্রজেক্টে যুক্ত ছিল। টাকার অংক বেশ বড়ই হবে তাহলে।’
রিয়ার শরীর একটা ঝাঁকি দিল। ও ধরা পরে গেছে। জায়ানের নাম চলে আসায় ও আর চুপ করে থাকতে পারল না। ডুকরে কেঁদে উঠল। এরা জায়ানের কোন ক্ষতি করবে নাত?
অফিসার জামান সিগারেট ধরাল।তিনি বুঝতে পারলেন এই মেয়ের দুর্বলতা হল জায়ান। জায়ানের নাম নিয়ে পেশার দিলেই সব কথা বলে দেবে।জায়ানকে ফাঁসিয়ে দেবেন এমন কিছু বলতে হবে। ওই ছেলেকে বাঁচানোর জন্য এই মেয়ে তাইলে নিজ থেকেই সব বলে দেবে। তিনি সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে বললেন...
‘আপনার আর কিছু বলার দরকার নেই। কেস আমরা নিজের মত করে সাজিয়ে নিচ্ছি। কাজের মেয়ের হাতে খুন হলে কেসটা জমবে না। এরকম কেস হাজার হাজার আছে। কেস দিতে হবে এই জায়ানের নামে। কাজের মেয়ের সাথে প্রেম। মিডিয়া লুফে নেবে। সেই মেয়ের সাথে মিলে টাকার জন্য মাকে খুন। ব্যাস আর কি চাই। সব জায়গায় শুধু এই নিউজ চলবে। অনলাইন, টিভিতে শুধু এই নিউজ। আমার সাক্ষাৎকার নেবে। প্রমোশন আর ঠেকায় কে? হারামি জায়ানকে সারাজীবন জেলের ভাত খাওয়াব। আজকালকার পোলাপান। মেয়ে মানুষ পাইলে হুশ থাকে না।তাও একটা কাজের মেয়ের জন্য...
অফিসার জামান কথা শেষ করতে পারেন না। একজন দৌড়ে এসে হাতে দুটো কাগজ দিল। একটা হল রিয়ার জামিনের কাগজ। আরেকটা জামানের সাসপেন্ড লেটার। এত দ্রুত জামিন কিভাবে পেল? সাসপেন্ড হয়েছে মানে জামান অনেক বড় কোন জায়গায় হাত দিয়ে ফেলেছে? উনি অবাক হয়ে রিয়ার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। এই মেয়ে কাজের মেয়ে হতেই পারে না। নিশ্চয়ই অন্য কোন বড় কাহিনী আছে।
অফিসার জামানের কপালটাই খারাপ। এত বড় একটা কেস হাত থেকে ছুটে গেল।
২৪।
রিয়া চোখ খুলে প্রথমে বুঝতে পারছিল না ও কোথায়। চারপাশটা ভাল করে দেখল। ওর কাছে মনে হল কোন একটা হাসপাতাল। ওর হাতে স্যালাইনের লাইন। সারা শরীরে অসহ্য ব্যথা। একটু দূরে মা বসে আছেন। মাকে দেখে চেনা কষ্ট। পোশাক আশাক, বসে থাকার ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে খুব ধনী পরিবারের কেউ। মায়ের এরকম চেহারা আগে কখনো দেখে নি ও।
-কিছু লাগবে ম্যাম ? একজন নার্সের মত কেউ একজন এসে জিজ্ঞেস করল।
-নাহ। মা সম্ভবত কিছু একটা নিয়ে ভাবছিলেন। নার্সের প্রশ্নে কিছুটা বিরক্ত হলেন।
-চা কফি কিচু খাবেন ম্যাম?
-নাহ।
-কিছু লাগলে বলবেন ম্যাম। আমি সামনেই থাকব।
এবার আর মা বিরক্তি চেপে রাখলেন না। ধমকের সুরে বললেন,
কিছু লাগলেত বলবই। কিন্তু আপনারা একেক জন একেক বার এসে এতবার জিজ্ঞাসা করলে আমি নিজেই ভুলে যাচ্ছি কিছু লাগবে কিনা।
-সরি ম্যাম বিরক্ত করে থাকলে। আসলে আপনার জন্য এত জায়গা থেকে ফোন আসছে যে আমরা নিজেরাই বেশ নার্ভাস।
-এত নার্ভাস হবার কিছু নেই। আপানারা বেশ ভাল সার্ভিস দিয়েছেন। আমি যাওয়ার সময় বলে যাব।
-থ্যাঙ্ক ইউ ম্যাম। মেয়েটি চলে গেল। মা ঘুরে রিয়ার দিকে তাকালেন।রিয়ার চোখ খোলা দেখে ওর মাথার কাছে এসে বসলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
-কিরে মা কেমন লাগছে এখন?
-ব্যথা আছে। আগের থেকে কম। একটু পানি খাব। রিয়া শোয়া থেকে ওঠার চেষ্টা করল
-আরেহ উঠতে হবে না। তুই শুয়ে থাক। খাট উঁচু করে দিচ্ছি। মা একটা সুইচ টিপলেন। খাট উঁচু হয়ে গেল। তারপর রিয়াকে পানি দিলেন। পানি খেতে খেতে রিয়া বলল,
-এত দামি হাসপাতালে কে ভর্তি করল মা? আখতার ফ্যামিলির কেউ?
-আখতার ফ্যামিলিকে তোর খুব ভাল লাগে?
-নাহ, কেন?
-নিজেকে যে আখতার ফ্যামিলির বলে পরিচয় দিতি।
-ওটা মুখ ফুসকে বেরিয়ে গেছি।পরে আর ঠিক করার সময় পাই নি।একটু থেমে বলল,
-জায়ানকে কে কি তুমি চেন মা? ও ঠিক আছে?
মার মুখটা একটু শক্ত হয়ে গেল। তিনি না শোনার ভাব করে বললেন,
-রেস্ট নে। ডাক্তার তোকে কথা কম বলতে বলেছে।
রিয়া প্রসঙ্গ পরিবর্তন করার জন্য বলল
-এত ভি আই পি হাসপাতাল কে ঠিক করে দিল মা?
-তোর ছোট মামা।
-ছোট মামা?
-একবার তোর স্কুলে খুব ঝামেলা হয়েছিল মনে আছে? তোকে টি সি দিয়ে দিতে চাচ্ছিল?
-হুম । তুমি কার সাথে দেখা করলে আমাকে নিয়ে। তিনি সব ঠিক করে দিল।
-ওই লোকটাই তোর ছোট মামা।
-কিন্তু তুমি বললে যে বলেছিলে তোমার ভাইরা সব এক্সিডেন্টে মারা গেছে?
-মারা যায় নি। মেরে ফেলা হয়েছিল তোর ছোট মামাকে যেন মেরে ফেলতে না পারে তাই পরিচয় গোপন রাখা হয়েছিল। আমার পরিচয় গোপন করে করে গার্মেন্টস কর্মী হিসেবে বেঁচে ছিলাম।
-তোমাদের মেরে ফেলতে চাইছিল কেন?
-এই যে হাসপাতালটা দেখছিস। এটার মালিক আমার ফ্যামিলি। শুধু এটাই না। এই শহরে এমন অনেক বড় বড় সম্পদ আছে যেটার মালিক আমার ফ্যামিলি। তুই যে আখতার ফ্যামিলির সম্পদ দেখে মাথা নষ্ট করে ফেলেছিলি ওরকম দশটা ফ্যামিলির সম্পদ একসাথে করলেও আমার ফ্যামিলির সমান হবে কিনা জানি না। এত সম্পদ তো আর এমনি এমনি আসে না। বৈধ পথে এদশে এত কিছু করা সম্ভব না। অবৈধ পথ ব্যবহার করতে হয়েছে। আর তা করতে গিয়ে অনেক শত্রু তৈরি হয়েছে।তারাই খুন করতে চাইছিল।
-তুমি কি বলতে চাইছ আমাদের ফ্যামিলি একটা মাফিয়া ফ্যামিলি?
-বলতে পারিস।
-আর আমার বাবা?
-সেও ছিল আরেক মাফিয়া। ভালবেসে আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিল। কিন্তু আমি বলেছিলাম আমাকে বিয়ে করতে হলে মাফিয়া জীবন ছাড়তে হবে।মাফিয়া জীবন আমার পছন্দ না। জীবনের কোন গ্যারান্টি নাই। যে কোন মুহূর্তর পুলিশ বা শত্রুর গুলি খেয়ে মারা যেতে পারে। সে রাজি হল। আমার সাথে গরীব জীবন শুরু করল।
-কিন্তু বাবা যে তোমার গায়ে হাত তুলত?
মা জবাব দেয়ার আগে নার্স দৌড়ে আসল।
‘ম্যাম মন্ত্রীসাহেব...
নার্সের পিছে পিছে দলবলে একজন নেতা টাইপ মানুষ ঢুকলেন। ঢুকে বাকি সবাইকে বের হয়ে যেতে বললেন। সবাই বের হলে মার দিকে তাকিয়ে বললেন,
-ভাবী ভাল আছেন?
-ভাল আছি। তুমি কেমন আছ মঞ্জু?
-আমাকে তুমি করে বলছেন কেন ভাবী ? পর করে দিলেন?
-না, সবসময় কি এক হয় নাকি।
-তো কি হইছে? আমি এখনো সেই আপনার সেই ছোট ভাই। কতদিন পর আপনার সাথে দেখা। প্রায় বিশ বছর।
-হুম অনেকদিন। আমাদের সেই ছোট মঞ্জু আজকে মন্ত্রী হয়ে গেছে।
-সবই তো আপনাদের দয়া ভাবী। ভাইজান সব কাম ধান্ধা আমার হাতে ছেড়ে দিলেন। আপনাকে নিয়ে আড়াল হয়ে গেলেন ।সেইসব সামলাতে গিয়াই আজকে এই অবস্থা। ভাইজানের কথা খুব মনে পড়ে ভাবী। আপনাকে কত ভালবাসত। আপনার এক কোথায় সব কাজ ছেড়ে দিয়ে আড়ালে চলে গেল।
-তোমার কথা খুব বলত তোমার ভাইজান। বলত তোমাকে সব ছেড়ে দিয়ে ভুল করে নি। তুমি অনেক ভাল করছ।
-জি ভাবী। ভাইজান আমার কাছেও গিয়েছিল কয়েকবার মাঝে। তবে একটা জিনিস কি জানেন ভাবী, ভাইজান আপানর কথায় এই লাইন ছাড়লেও ভুলতে পারে নাই। অন্য কোন কামে মন ও দিতে পারে নাই ।আবার এই লাইনেও ফিরতে পারে নাই । আপনার সাথে গাদ্দারি করতে চায় নাই। শেষের দিকে এসব নিয়ে অনেক মনে কষ্টে থাকত। মদ তদ খেত। আপনার সাথেও নাকি খারাপ ব্যবহার করত। খুব আফসোস করত আমার কাছে এসে।
-বাদ দাও এসব কথা। হঠাৎ এদিকে কি মনে করে?
-ভাতিজিকে একটু দেখতে আসলাম। কিসব ঝামেলা নাকি হইছে। আমি বলছি সব মিটায়ে ফেলতে। টিভি দেখেন নাই? টিভিতে সব দেখার কথা।
মা টিভি ছাড়লেন। টিভিতে দেখাচ্ছিল বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও সামজসেবক শাহানার খুনি গ্রেফতার। খুনিকে দেখে রিয়া চমকে উঠল। জয়নাল। এরা সবাই মিলে রিয়াকে বাঁচাতে জয়নালকে ফাঁসিয়ে দিয়েছে।
-কি ভাতিজি খুশি এখন? তোমার ছোট মামা বজলু অবশ্য তোমার জন্য একটা গিফট পাঠাইছে।বলতে বলতে রিয়ার হাতে একটা খাম তুলে দিল। খাম খুলে রিয়া দেখল একটা আংটি। পরিচিত লাগল। রিয়ার মনে পড়ে গেল। অফিসার জামানের আংটি। আংটিতে রক্ত মাখা। তাইলে কি এরা অফিসার জামান কে? রিয়া ভাবতে চাইছিল না। মানুষটা ভাল ছিল। গায়ে হাত তুললেও একবারও রিয়াকে অসম্মান করে নি। অপমান করে নি। রিয়া বিষয়গুলো ভুলে যাবার চেষ্টা করল। ক্ষমতাবানদের জীবন মনে হয় এমনই । খুন করলে তার সাজা আরেকজন ভোগ করবে। কেউ সাজা দিতে চাইলে তার হাতের আংটিতে রক্ত লেগে থাকবে।
২৫।
কয়দিন পর রিয়া হসাপাতাল থেকে ছাড়া পেল। ওরা একটা বাগান বাড়িতে গিয়ে উঠল। বিশাল বড় বাড়ি। নিজস্ব মাঠ, পুকুর, বাগান, হাঁটার জায়গা সবই আছে। চমৎকার জায়গা। রিয়া নিজের মত করে বাগানে ঘুরে বেড়ায়।মন খারাপ হলে মায়ের কোলে শুয়ে থাকে।ওর কিছুদিন আগের জীবনকে এখন বড় একটা দুঃস্বপ্ন মনে হয়। আর জায়ান? কিছু ভাবেনি এখনো। মা বলল সব ভালোবাসা সুন্দর হয় না। কিছু ভালোবাসায় অভিশাপ থাকে। রিয়া আর জায়ানের ভালোবাসা নাকি অভিশপ্ত। রিয়া যে একটার পর একটা খুন করল এই কারণে। এই অভিশাপ কাটানোর একটাই রাস্তা। নিজের ভালবাসা থেকে দূরে সরে যাওয়া।ওর মা ঠিক করেছে ওরা দুইজন দুবাই চলে যাবে।সেখানে ওদের পারিবারিক ব্যবসা দেখাশুনা করবে।রিয়া নতুনভাবে জীবন শুরু করবে। নিজের করা পাপের শাস্তি হিসেবে ও ওর ভালোবাসা থেকে দূরে একা একা জীবন কাটাবে। এটা ওদের দুইজনের জন্যই ভাল। আর এত কিছুর পরও রিয়া জায়ানকে ছাড়তে না চায় তাহলে? সেক্ষেত্রে ওর মার কিছু বলার নেই। রিয়ার নিজের জীবনের সিদ্ধান্ত নিজেকে নিতে হবে। ওর মা ওকে সংগ দেবে না। রিয়ার মনে রাখতে হবে পাপের শাস্তি রিয়াকে পেতেই হবে। পাপ কখনো ক্ষমা করে না। রিয়া এখনো সিদ্ধান্ত নেয় নি। ভালবাসা ছেড়ে দূরে গিয়ে পাপের প্রায়শ্চিত্ত করবে নাকি ভালবেসে অভিশপ্ত জীবন বেছে নিবে? রিয়ার সন্দেহ হচ্ছে অভিশপ্ত জীবন বলতে কিছু নেই। ওর ছোট মামা চায় না রিয়া জায়ানের সাথে থাকুক। ছোট মামা এখন এই পরিবারের প্রধান। তার কথার বাইরে যাওয়ার সাহস মায়ের নেই। তাই তিনি পাপ পুণ্যের হিসেব নিয়ে এসেছেন। ছোট মামা অবশ্য রিয়াকেও সরাসরি বলেছেন। তিনি বললেন, আজ হোক বা কাল হোক জায়ান জানতে পারবে রিয়া জায়ানের মাকে খুন করেছে। তখন কি জায়ান রিয়াকে ভালবাসবে? এমন ও হতে পারে প্রতিশোধ নেয়ার জন্য রিয়ার কোন ক্ষতি করে ফেলতে পারে।মিডিয়ায় রিয়ার খুনের কথা প্রকাশ করে দিতে পারে। সাথে সাথে তখন এই পরিবারের কথাও মিডিয়ায় চলে আসবে। শত্রুরা এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে পুরো পরিবারকে ধ্বংস করে দিতে পারে। এই ঝুঁকি নেয়া যাবে না। রিয়াকে জায়ানের কাছ থেকে দূরে যেতে হবে এটাই সিদ্ধান্ত। এতদিন রিয়া যা ইচ্ছে তা করেছে কেউ বাঁধা দেয় নি। কিন্তু এখন রিয়া তাদের পরিবারের সদস্য। এই পরিবারের সিদ্ধান্ত রিয়াকে মানতেই হবে। না মানলে তার পরিণতি হবে ভয়ঙ্কর। রিয়া একবার বলতে চেয়েছিল ভয়ঙ্কর বলতে? আপনি কি জায়ানকে মেরে ফেলবেন? পরে আর জিজ্ঞেস করল না। ও নিজের মত সময় কাটাতে লাগল।জায়ানের সাথে কোন যোগাযোগের চেষ্টা করে নি। তবে একটা বিষয় ওর কাছে পরিষ্কার হল। এতদিন ওর কিছুই ছিল না, শুধু জায়ান ছিল। আজ ওর সব কিছু আছে, শুধু জায়ান নেই। ও মাঝেমধ্যে গাড়ি নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। বড় বড় মার্কেটের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। একসময় কত ড্রেস রিয়া টাকার অভাবে কিনতে পারেনি। মাঝে মধ্যে ভালমন্দ কিছু খেতে ইচ্ছে করত। ভাল ভাল খাবারের দোকানের সামনে ঘুরে বেড়াত। টাকার অভাবে ঢুকতে পারত না। আর এখন চাইলে রিয়া কত কিছুই না করতে পারে। কিন্তু কিছুই করতে ইচ্ছে করে না। একদিন কি মনে করে ধানমন্ডি লেকের পাশে গেল। গিয়ে দেখল জায়ান বসে আছে একা একা। রিয়া গাড়ি থামাল। জায়ানের পাশে গিয়ে বসল। জ্যায়ান বুঝতে পারল রিয়া এসেছে কিন্তু কিছু বলল না। যেন রিয়া এই সময়ে এমনি ভাবে প্রায়ই ওর পাশে এসে বসে। রিয়া নিজেই কথা শুরু করে,
-আকাশে অনেক মেঘ জমেছে দেখেছ?
-হুম । বৃষ্টি হবে।
-বৃষ্টিতে ভিজতে ইচ্ছে করেছে।
-চল ভিজি।
-অফিস নেই?
-চাকুরী ছেড়ে দিয়েছি।
-কেন?
-ভাল্লাগছিল না।
-মায়ের জন্য মন খারাপ?
-হয়তবা।
-আমাদের প্রেমটা না হলেই বোধহয় ভাল ছিল।
-কেন?
-তোমার মা বেঁচে থাকতেন ।
-প্রেমের সাথে মায়ের মারা যাওয়ার কি সম্পর্ক ?
-কিছু না।
জায়ান রিয়ার দিকে তাকাল। ওর চোখে অবাক প্রশ্ন। রিয়া চোখ নামিয়ে নিল। এই প্রশ্নের জবাব দেয়ার সাহস রিয়ার নেই। অন্যদিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,
-আমাকে মনে পরে নি এতদিন?
-খুব।
-খোঁজ নাও নি যে?
-তোমার ফোন বন্ধ ছিল।
-আমি যদি হারিয়ে যেতাম?
-তুমি ফিরে আসবে আমি জানতাম।
-যদি না আসতাম?
-আমি অপেক্ষা করতাম।
-কতদিন?
-অনন্তকাল।
-আমি যে অনেক খারাপ একটা মেয়ে এটা কি জান?
-জানতাম না।
-জানতে ইচ্ছে হয় না?
-নাহ
-কেন?
-তোমাকে একটা কথা বলি?
-বল।
-চল আমরা হারিয়ে যাই। দূরে কোথাও। শুধু আমি আর তুমি। আজকাল মনে হয় আমার শুধু তুমি লাগবে। এই জীবনের কাছে আর কিছু চাওয়ার নেই।
রিয়ার চোখ ছল ছল করল। ঠিক যেন এই কথাটাই ওর মনের গভীরে লুকিয়ে ছিল। বৃষ্টি নামল। ওরা দুইজন বৃষ্টিতে ভিজতে থাকল ।
0 মন্তব্যসমূহ