জুলাই আন্দোলনের অন্য গল্প


 

ছেলেটার বয়স কম। কত হবে? বিশ? নাকি আরও কম। ধনীদের বয়স তো ঠিকঠাক বোঝা যায় না। রিনি বুঝতে চেষ্টা করে না। ঢাকার নামিদামি বারগুলোতে ও নাচ করে। মাঝে মাঝে ওর  নাচ দেখে কারো ভালো লাগে। তখন তারা রিনির সাথে একান্তে সময় কাটাতে চায়। টাকার বিনিময়ে রিনি রাজি হয়। ওর বন্ধু কামাল সব ব্যবস্থা করে—কোন বারে নাচবে, কাকে সময় দেবে। বিনিময়ে রিনির আয়ের একটা অংশ কামালকে দিতে হয়। টাকা দিতে ওর ইচ্ছে হয় না—এত কষ্ট করে আয় করা টাকা। কিন্তু নিরাপত্তার প্রশ্নও আছে। এই পেশায় নানা রকম মানুষের সাথে উঠবস করতে হয়। কে কী ভাবছে, কে জানে? একা ঘরে থাকতে থাকতে কেউ যদি খুন টুন কিছু করে বসে? কামালের মতো কেউ পাশে থাকলে ভরসা পাওয়া যায়।

ছেলেটা কামালের মাধ্যমেই রিনির ঘরে এসেছিল। প্রথমে তার কম বয়স দেখে রিনি একটু দ্বিধায় পড়েছিল। কিন্তু তারপর ভেবেছে—ছেলেত সবাই এক। এই পেশায় এসে এটাই শিখেছে। বয়স কোনো ব্যাপার না। রিনি শুধু নিজের কাজটা ঠিকঠাক করে। কাজ শেষ হলে টাকা। পুরো সময়টা সে টাকার কথাই ভেবে নিজেকে শান্ত রাখে।

সবকিছু শেষ হলে দুজনেই কাপড় পরে। টাকা দেবার সময় ছেলেটা একটু বিভ্রান্ত দেখাল।

"আমার মনে হয় মানিব্যাগ ফেলে এসেছি।"

"সমস্যা নেই। কামালের কাছে দিয়ে দেবেন।"

ছেলেটা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল, তারপর রিনির সামনে একটা চাবি রাখল।

"এটা রাখুন।"

কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই চলে গেল।

কিছু বুঝতে না পেরে রিনি কামালকে ডাকল।

"তুই বলছিস, ও তোকে গাড়ি দিয়ে গেছে?" চাবি হাতে নিয়ে কামাল লটারি জেতার মতো তাকিয়ে রইল।

রিনি মাথা নাড়ল।

"ও সৈয়দ আমিরের ছেলে। দেশের টপ ফাইভ ধনী পরিবারের একজন। এরকম ছেলে... তোকে পছন্দ হয়েছে মনে হয়। তাই গাড়ি দিয়ে গেল।"

"দিয়ে গেল মানে?"

"এখন এ গাড়ি তোর। তুই চালাবি।"

"আমি চালাব? আমার তো নিজের থাকার জায়গাই নেই। এ গাড়ি আমি কোথায় রাখব?"

"আরে, আমি দেখছি কী করা যায়।"

কামাল চুপচাপ গাড়ি বিক্রি করে দিল—ভালো দামেই। নিজের জন্যও কিছু রাখল।

"শোন," সে সিগারেট টানতে টানতে বলল, "এই ছেলেকে কাজে লাগা। ধরে রাখ। এমন সুযোগ জীবনে একবারই আসে। তোর জীবন বদলে যাবে।"

রিনি কিছু বলল না, কিন্তু শুনল।

ছেলেটা আবার রিনির কাছে এল।

এবার কিছুক্ষণ গল্প করার চেষ্টা করল। জিজ্ঞেস করল গাড়িটা পছন্দ হয়েছে কিনা। রিনি লুকাল না—যা সত্যি, তাই বলল।

ছেলেটা নির্বিকারভাবে শুনল। সারা রাত ওরা একসাথে কাঁটাল।তারপর পরের দিন রিনিকে আরেকটা নতুন গাড়ি কিনে দিল—একটা ফ্ল্যাটও। যাতে গাড়িটা রাখার জায়গার অভাবে বিক্রি করতে না হয়।

কামাল আনন্দে আত্মহারা। "দেখলি? আমি তো আগেই বলছিলাম! একে আঁকড়ে ধরে রাখ! আর তোর এই গরিব বন্ধুটার কথাও একটু মনে রাখিস।"

রিনি হেসে বলল, "মনে রাখার কিছু নেই। এসব যেমনে আসে, তেমনেই চলে যাবে। তুই বরং আমাকে ছেড়ে যাস না। একা আমি এত কিছু সামলাব কীভাবে?"

"আরে, আমি তো আছি তোর সাথে," কামাল ভরসা দিল।

তারপর এল ৫ই আগস্ট ২০২৪।

দেশের সরকার উধাও—হঠাৎ করেই!চারিদিক তীব্র আন্দোলনকোনো প্রেস কনফারেন্স নেই, নেতারা নেই। টিভিতে আতঙ্ক। পুরো শহর ভয় আর গুজবে ঠাসা। চারদিকে রক্তের গন্ধ। লুটপাট চলছে—যে যত পারছে নিয়ে যাচ্ছে। আইন-শৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছে।

সেই রাতে ছেলেটা আবার এল—কাঁপছে, চোখ লাল, এক অদ্ভুত ভয় নিয়ে।

"আমার কিছু টাকা এখানে রাখতে হবে। অন্য কোথাও নিরাপদ না।"

কামাল তখনো সেখানে ছিল—সে দেখল কালো পোশাকের লোকেরা ব্যাগের পর ব্যাগ রিনির অ্যাপার্টমেন্টে রাখছে।

"হায় আল্লাহ..." কামাল ফিসফিস করে বলল।

ব্যাগ খুলতেই দেখা গেল—নোটের স্তূপ।

ছেলেটা কিছু বলল না। শুধু চলে গেল।

আর ফিরে এল না।

দিন যায়, মাস যায়।

কামাল জিজ্ঞেস করল, "তোর কি মনে হয়, ও ফিরবে কখনো?"

রিনি চুপ।

তার নতুন জীবন শুরু হয়েছে। নতুন নাম। অভিনয় শেখা শুরু করেছে—ক্যামেরার সামনে দাঁড়ানো, অডিশন, বিজ্ঞাপন। কামাল সব ঠিক করে দেয়।

সে এখন রিনির ম্যানেজার।

"তুই তারকা হবি," কামাল বলত, "আর আমি তোকে তারকা বানাবো।"

কিন্তু সেই টাকাগুলো ঘরেই রয়ে গেল—অন্ধকারে, নিঃশব্দে।

বৃষ্টির এক রাতে রিনি টাকার রুমটাতে গেল।

লাইট জ্বালাল।

ব্যাগগুলো ঠিক আগের মতোই পড়ে আছে।

ও বসে পড়ল।

গোনা শুরু করল।

কামাল দরজায় দাঁড়িয়ে। "তুই সত্যিই এগুলো গুনবি?"

"আমি জানতে চাই," রিনি বলল।

এক লাখ... দুই লাখ... দশ...

ঘণ্টা পার হয়ে গেল।

"তুই জানিস এখানে কত টাকা আছে?" রিনি ফিসফিস করে বলল।

কামাল মাথা নাড়ল। "এত টাকা... শুধু একটা ছেলের। তাহলে ওর বাবার কত টাকা ছিল ভাবা যায়? এই শূকরগুলো কত লুট করছে? একটা মানুষের বাঁচতে কত টাকা লাগে?"

বাইরে বজ্রপাত হল—যেন সাবধান করে দিল।

এত টাকা নিয়ে তারা কী করবে? খুব সাবধানে এগোতে হবে।

রিনি টাকার স্তূপের দিকে তাকিয়ে রইল—ধুলোয় মোড়া, বিস্মৃত, কিন্তু ক্ষমতায় ঠাসা।

"ও যদি আর না ফেরে?" রিনি নিজেকেই জিজ্ঞেস করল।

"আর ও কেন আমাকে এত টাকা দিয়ে গেল?"

কামাল চুপ।

আর সেই নীরবতার মধ্যেই রিনি বুঝে গেল—

ওর ভাগ্য বদলে গেছে।

ঠিক যেমন বদলে গেছে আরও অনেকের।

 

 









একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ